ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসন নীরব

ময়মনসিংহে ভুঁইফোঁড় স্কুলের ছড়াছড়ি ॥ ভর্তিবাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

ময়মনসিংহে ভুঁইফোঁড় স্কুলের ছড়াছড়ি ॥  ভর্তিবাণিজ্য

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ শিক্ষা নগরী বলে খ্যাত বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহে রাতারাতি গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভুঁইফোঁড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনুমোদনহীন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। অভিভাবকদের জিম্মি করে চলছে গলাকাটা ভর্তি ফি আদায়ের মহোৎসব। বিএনপি ও জামায়াতপন্থী মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তি ফি আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ম-নীতিমালার কোন তোয়াক্কা করছে না। সরকারের জারি করা নিয়মের অতিরিক্ত ও বাড়তি ফি আদায় করছে প্রকাশ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারী বিধিমালা না মেনে শিক্ষক নিয়োগেও রয়েছে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যের অভিযোগ। অথচ অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ খেয়াল খুশি মতো মোটা অঙ্কের ভর্তি ফি আদায়ের এই বিষয়টি দেখার কেউ নেই ময়মনসিংহে! অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা বিভাগের স্থানীয় কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ এমপিওভুক্ত ও সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত এক শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান অনুমোদনহীন এসব ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা দিচ্ছে। সরকারী বরাদ্দের বই পেতেও কোন বেগ পেতে হচ্ছে না। শহরের রামবাবু রোডে গত ২০১৬ সাল থেকে কোন প্রকার অনুমোদন ছাড়াই ভাড়া করা একটি বাসায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে আফরোজ খান মডেল স্কুল। বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আফরোজ উদ্দিন খান স্কুলটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, বর্তমানে ৩য় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত চালু স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। আর শিক্ষকের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। চার হাজার টাকা উন্নয়ন ফিসহ ভর্তির ক্ষেত্রে আদায় করা হচ্ছে ৬৮০০ টাকা! শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গত ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর সর্বশেষ জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, কোন প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন খাতে ৩০০০ টাকার বেশি নিতে পারবে না। অনুমোদন ছাড়া কিভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এবং সরকারী পরিপত্র মানছেন না কেন? এমন সব প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক আফরোজ খান জানালেন, শহরের প্রগেসিভ মডেল স্কুলসহ সবকটি প্রতিষ্ঠানই তো এভাবে চালাচ্ছে। স্থানীয় শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে বোর্ড পর্যন্ত বিষয়টি অবগত আছে বলেও দাবি করেন এই প্রধান শিক্ষক। বাড়তি ও অতিরিক্ত উন্নয়ন ফি নিয়ে কি করছেন? প্রশ্নে প্রধান শিক্ষক জানান, ক্লাসে এসি সংযোজন ও সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ এই টাকায় ভাড়া নেয়া বাসার উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে, শহরের বাইরে চরহরিপুর গ্রামে স্কুলের নামে জমি বায়না করা হয়েছে। দেখা গেছে প্রতিটি বেঞ্চে ৩ জন শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি অবস্থায় বসানো হয়েছে। মাল্টি মিডিয়ায় ক্লাস ও কম্পিউটার সুবিধাও অপর্যাপ্ত বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে শহরের প্রগেসিভ মডেল স্কুল, ময়মনসিংহ বয়েজ মডেল স্কুল, মেট্রোপলিটন মডেল স্কুল, প্রতিশ্রুতি আইডিয়াল হাই স্কুল, হলিসোল কিন্ডার গার্টেন এ্যান্ড হাইস্কুল, প্রেসিডেন্সি মডেল স্কুল, লোটাস পাবলিক স্কুল, শাহীন স্কুল, ডেফোডিল মডেল স্কুল, ফার্স্ট মিডিয়া স্কুল, নলেজ পাওয়ার মডেল স্কুল, মহানগর মডেল স্কুল ও আলবুরুজ জিনিয়াস মডেল স্কুলসহ প্রায় অর্ধশত অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোচিং সেন্টার পরিচালনা ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। শহরের গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল্লা হেল শাফী পরিচালিত প্রগেসিভ মডেল স্কুল পাঠদানের অনুমোদন পেয়েছে গত ২০১৩ সালে। এর আগে গত ২০০৬ সাল থেকে স্কুলটি শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে অনুমোদন ছাড়াই। কৃষিবিদ আনিসুজ্জামান খান ও চিকিৎসক ডাঃ মীর আনোয়ার হোসেনের মালিকানার ভাড়া করা বাসাতে চলমান প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১৬০০ এর বেশি শিক্ষার্থী ও ৭১ জন শিক্ষক রয়েছে। অনুমোদনের শর্তে বলা আছে, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গায় ভবন থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ হেল শাফী জানান, স্কুলের নামে চরে জায়গা রয়েছে। কোথায় সেই জমি এবং কবে নাগাদ নিজস্ব জায়গায় স্কুল সরিয়ে নেয়া হবে প্রশ্নের কোন স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি প্রধান শিক্ষক। বাড়তি ও অতিরিক্ত ফি আদায় প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সবাই নিচ্ছে বলে তিনিও নিচ্ছেন। এটি অনৈতিক নয় বলেও দাবি এই প্রধান শিক্ষকের। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে এই স্কুলের এক অভিভাবক জানালেন, ভর্তির জন্য ৬৫০০ টাকা এবং সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাত হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে এমন নৈরাজ্য বন্ধ করতে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন এমপিওভুক্ত ও অনুমতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ শিক্ষক সমিতির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তারপরও বন্ধ হয়নি বেপরোয়াভাবের অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। অভিযোগ রয়েছে-এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষক নিয়োগের নামে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করে আসছে। আর এসব কাজে শিক্ষা বিভাগের স্থানীয় কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ এমপিওভুক্ত ও অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং শিক্ষক সমিতির কয়েক নেতা সহায়তা করে সুবিধা নিচ্ছে। অভিযোগ সরাসরি স্বীকার না করলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপ পরিচালক আব্দুল খালেক এবং ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম জানান, অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার কোন নজির নেই।
×