ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ

জননিরাপত্তা ও একটি পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

জননিরাপত্তা ও একটি পর্যবেক্ষণ

২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘মানব নিরাপত্তা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। সে বছরের ২৫ অক্টোবর এই সংজ্ঞাকে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলন অনুমোদন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তার ধারণাকে জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত করেছে। এসব ক্ষেত্র হচ্ছেÑ অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অর্থ রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ব্যক্তিকে যেভাবে ভীতিমুক্ত দেখতে চেয়েছেন, জাতিসংঘের ওই সব কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রয়াস রয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ব্যক্তি বা মানব নিরাপত্তা ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘চবড়ঢ়ষব যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় ষরাব ধহফ ভৎববফড়স ধহফ ফরমহরঃু. ঋৎবব ভৎড়স ঢ়ড়াবৎঃু, ধহফ ফবংঢ়ধরৎ... রিঃয ধহ বয়ঁধষ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু ঃড় বহলড়ু ধষষ ঃযবরৎ ৎরমযঃং ধহফ ভঁষষু ফবাবষড়ঢ়বফ ঃযবরৎ যঁসধহ ঢ়ড়ঃবহঃরধষ’. জাতিসংঘের এ প্রস্তাবনার প্রতি রাষ্ট্রগুলো তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বস্তুত রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নির্ভর করে জনসমষ্টির ওপর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে যে চারটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তা হলো- জনসমষ্টি, ভূ-খ-, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। জনসমষ্টি রাষ্ট্রের নিয়ামক। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র কোনটি? আয়তনে যেটি বড় সেটি, নাকি যেটি জনসংখ্যায় বড় সেটি? নিঃসন্দেহে জনসমষ্টি রাষ্ট্রের সমার্থক। রাষ্ট্রের রয়েছে তিনটি অঙ্গ- আইন বিভাগ (খবমরংষধঃঁৎব), নির্বাহী বিভাগ (ঊীবপঁঃরাব) এবং বিচার বিভাগ (ঔঁফরপরধৎু)। এসব বিভাজন মানুষের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং জীবনযাপন সুখময় করার জন্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ’ (এৎবধঃবংঃ যধঢ়ঢ়রহবংং ঃড় ঃযব যরমযবংঃ হঁসনবৎ ড়ভ ঢ়বড়ঢ়ষব) নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। মানুষের জন্য সরকার। সরকারের জন্য মানুষ নয়। মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রতিভূ সরকারের দায়িত্ব। সরকারের তরফ থেকে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। এসব হচ্ছে- প্রতিরক্ষা বাহিনী, সীমান্ত রক্ষাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায়িত্ব পুলিশের। আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীকে সবকিছু সামাল দিতে হয়। সকল অনৈতিক, অবক্ষয়, অপচয়, দুর্নীতি, সহিংসতা, পারিবারিক সংঘাত, শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ, গুম, হত্যা, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, বাজার অব্যবস্থা, পরিবেশ বিপর্যয়, ইত্যকার সবকিছুকেই একা পুলিশ বাহিনীর সামাল দেয়া সম্ভব? রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে যদি সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয় বা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভীত যদি নড়বরে হয়ে যায়, সর্বোপরি রক্ষক যখন বক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকে, তখন পুলিশ বাহিনীর পক্ষেও যত শত শক্ত সামর্থ্যবান অবস্থা নিয়ে থাকুক না কেন, তার পক্ষে পেশাগত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পুলিশ বাহিনী তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ও সেবার মহান ব্রতকে ভুলে যায় আর তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যদি ফাটল দেখা যায় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে সামাজিক ভারসাম্য বিঘিœত হতে বাধ্য। নাগরিক নিরাপত্তা এবং জনকল্যাণ হবে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। আমরা প্রায়ই জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলি বা অনেক সময় বিজ্ঞজনের কাছ থেকে শুনে থাকি। সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি একটি বিশেষ ধারণার (কনসেপ্ট) মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ধারণাটি হলো, জাতীয় নিরাপত্তা মানে হচ্ছে, সামরিক বাহিনী আর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা। বিষয়টি আসলে তা নয়। যদিও জাতীয় নিরাপত্তার ধারণাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সমাজবিজ্ঞানী তথা মিলিটারি-কূটনীতিকদের উদ্ভাবনা; তবে ওই ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন হয় শীতল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই। এ ধারণার ব্যাপকতা আরও প্রসারিত হয় শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই। জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্নিহিত উপাদানগুলোর মূলে রয়েছে নাগরিক নিরাপত্তা। নাগরিক নিরাপত্তার জন্যই রাষ্ট্র, সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ। এই নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত খাদ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে ব্যক্তি নিরাপত্তা আর সে কারণেই সার্বভৌম রাষ্ট্র। শাসন ব্যবস্থা নাগরিক নিরাপত্তা দুটো জাতীয় নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নাগরিক নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের তবে বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে যথেষ্ট যতœবান বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। শাসনব্যবস্থা আর নাগরিক নিরাপত্তা (হিউম্যান সিকিউরিটি) দুটো জাতীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে সুশাসন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতিসংঘের সংজ্ঞানুসারে নাগরিক নিরাপত্তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মানবিক বিষয়, অর্থনীতি এবং সামাজিক-আঙ্গিক ইত্যাদি জড়িত, যার মাধ্যমে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে এর কয়েকটি উপাদান চিহ্নিত করেছে। যেগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে সংগঠিত ও অসংগঠিত সন্ত্রাস থেকে নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপশাসন। রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং পরিবেশ সংরক্ষণ; যদিও অপশাসনের তেমন প্রণিধানযোগ্য সংজ্ঞা নেই; তবে নাগরিক নিরাপত্তা সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানÑ এ বিষয়ে জাতিসংঘের ইউএনডিপির সম্পৃক্ততা থেকেই প্রতীয়মান। বাংলাদেশে সার্বিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার তেমন চর্চা হতে দেখা যায় না। আলোচনা হয় শুধু দু-একটি প্রতিষ্ঠানে; তবে সেসব প্রতিষ্ঠানেও বেশির ভাগ সময় সার্বভৌমত্ব এবং কিছু অন্যান্য উপাদান নিয়েই আলোচনা হয়। আলোচনায় এখনও মাত্রা পায়নি অপ্রচলিত নিরাপত্তা (নন-ট্র্যাডিশনাল সিকিউরিটি-এনটিএস)। অপ্রচলিত নিরাপত্তার গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হলো, জনগণের নিরাপত্তা বিঘিœত করে এমন বেসামরিক হুমকি (নন মিলিটারি থ্রেট), যেখানে ব্যক্তিনিরাপত্তার বিষয়টিও অন্যতম উপাদান। আমাদের দেশে সবেমাত্র কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে এ বিষয়ে চর্চা শুরু হয়েছে মাত্র। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি একাডেমিতেও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ের উপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকৃত কোর্স শুরু হয়েছে। এগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে জননিরাপত্তা বিষয়ের ধারণায় নাগরিক সমাজ সমৃদ্ধ হবে এবং জননিরাপত্তা ও সুদৃঢ় হবে। ব্যক্তিনিরাপত্তা নিয়ে যদি আলোচনা করা যায়, প্রথমেই উঠে আসবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর ব্যাপক দুর্নীতি। দ্বিতীয়টি ব্যক্তিনিরাপত্তা। এই দুটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা গত দুই দশকে ব্যক্তিনিরাপত্তা আশানুরূপভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি। আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে যথেষ্ট যতœবান বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের হলেও সমাজ-সচেতন না হলে নিশ্চয়তা সম্ভব নয়। সমাজ-সচেতনতার জন্য প্রয়োজন সামাজিক জাগরণের। সামাজিক জাগরণের অভাবে ধর্ষণ, গুম আর হত্যার মধ্যে নাগরিক নিরাপত্তা বিপর্যয়ের মুখে। সরকার তথা দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব জাতীয় নিরাপত্তা তথা অপ্রচলিত নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা করা। আরও প্রয়োজন অধিকতর সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। সুশাসনের প্রবক্তারা বলে থাকেন, যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনুপস্থিত সেখানে নিরাপত্তা বা যে কোন কল্যাণ প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। অর্থবহ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ব্যতীত যেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; সেরূপ জনগণের সক্রিয় আন্দোলন ব্যতীত কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারে না। নাগরিক সাধারণকে তাদের নিরাপত্তা, সম্পদ ও সম্মান লাভের জন্য অবশ্যই সংগঠিত সচেতন ও বলিষ্ঠ সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নাগরিকদেরই নাগরিক নিরাপত্তার জন্য অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। জনগণ যদি ক্ষমতার উৎস হয় তাহলে তাদের বিজয় অনিবার্য। এক্ষেত্রে যদি কোন প্রতারকচক্র বা ফাঁদ তৈরির কোন কারখানার মালিক বা কোন শোষক ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয় বা পুতুলের মতো ব্যবহৃত হতে থাকে তাহলে বিজয়ের পরিবর্তে শোষণ চিরস্থায়ী রূপ লাভ করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন ধুলায় ভূ-লুণ্ঠিত হবে। পতন হবে অবধারিত। এ বিষয়ে রাজনৈতিক সর্বোচ্চ সতর্কতা জ্ঞান ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী। রাজনীতি যদি হয় মানুষের কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য তাহলে সর্বাগ্রে মানুষ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতদিন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা এজেন্সি সে সেদেশের সব মানুষের মোবাইল, ল্যান্ড ফোন, ইন্টারনেটসহ সব ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি চালু করেছে। সম্প্রতি এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তা নিয়ে শুরু হয় মহা হৈচৈ। শেষপর্যন্ত তা গড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদ পর্যন্ত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কংগ্রেস এবং সিনেটে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গোয়েন্দা সংস্থার ওই নজরদারি ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। তাই আজ দৃঢ়ভাবে বলার সময় এসেছে যে, মানুষের ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হয় এমন কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী চলতে পারে না। রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য রুলস্ অব ইনগেজমেন্ট অনুসারে যতটুকু ফোর্স প্রয়োগ করা দরকার তা নির্ধিদ্বায় করতে হবে। সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদবলে রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা তাদের দিয়েছে। লেখক : গবেষক
×