ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

সাহসী সাংবাদিকতার অসাধারণ ছবি

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

সাহসী সাংবাদিকতার অসাধারণ ছবি

পত্রিকার নিউজরুম বা সংবাদকক্ষ একটা নেশা ধরানোর মতো স্থান হতে পারে। কোন কোন দিন এতে এমন বিদ্যুতের প্রবাহ খেলে যায় যে, তা উপভোগ করার মতো। তখন প্রতিটি ডেস্কই বৈঠকের জায়গা হয়ে যায়। আর প্রধান সম্পাদকের কক্ষটা হয়ে দাঁড়ায় ছোটখাটো শহরের সরকারী অফিসের মতো, যেখানে শশব্যস্ত রিপোর্টারদের ঘনঘন আসা-যাওয়া চলতে থাকে। নিউজরুম এমন এক জায়গা যেখানে আদব-কায়দা ও ভব্যতার কোন স্থান নেই। এদিক দিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গের নতুন ছায়াছবি ‘দি পোস্ট’কে একটা প্রামাণ্যচিত্র বলা যেতে পারে। এর মধ্যে রমরমা ভাব আছে, ক্রোধ আছে, উত্তাপ আছে এবং নির্লজ্জ আবেগপ্রবণতাও আছে। এ ধরনের ছবি একমাত্র স্পিলবার্গই বানাতে পারেন। এমন একটি ছবি আমাদের সময়কার সেরা ছবিগুলোর অন্যতম বলে সমালোচকরা মনে করেন। স্পিলবার্গের ‘দি পোস্ট’ ছবিটি ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকান জনগণের কাছে মার্কিন সরকারের মিথ্যাচার উন্মোচন করে দিতে সরকারের গোপন দলিল প্রকাশ করার জন্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার চাঞ্চল্যকর কাহিনী। এর পাশাপাশি চলেছে বেন ব্রাডলির নেতৃত্বে ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে নিক্সন প্রশাসনের নজিরবিহীন লড়াই। এর আগে নিউইয়র্ক টাইমস এসব স্পর্শকাতর দলিল প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাদের তা ছাপতে দেননি। ইতিহাসে এই প্রথম কোন সরকার এ ধরনের কাহিনীর ওপর রিপোর্ট পরিবেশন করার সুযোগ দিতে কোন সংবাদপত্রকে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ব্রাডলি ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ক্যাথরিন গ্রাহাম এটাকে বিশ্বের পাঠক সমাজের কাছে ওয়াশিংটন পোস্টের ভাবমূর্তি বাড়ানোর একটা সুযোগ হিসেবে দেখেন। পোস্টের রিপোর্ট কি ধরনের হতে পারে এবং কি অসাধ্য সাধন করতে পারে তা দেখানোর এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাননি। অনতিক্রম্য বাধা মোকাবেলা করে তারা এগিয়ে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের নিজস্ব একদল আইনজীবী ছিল যাদের অত্যন্ত মোটা বেতনে রাখা হতো। তাদের কারোর পরামর্শ এ দু’জন শোনেননি। নিষেধ গ্রাহ্য করেননি। তাদের নিজেদের ও খোদ ওয়াশিংটন পোস্টের মান-মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার, এমনকি তাদের কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। তথাপি তারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল খোদ দেশের ভবিষ্যতই যেখানে বিপন্ন সেখানে এই ঝুঁকি কিছুই না। স্পিলবার্গের সাহসী ছায়াছবি ‘দি পোস্ট’ জঙ্গলের ঘটনা দিয়ে শুরু। তারপরই দৃশ্যপট স্থানান্তরিত হয়েছে ওয়াশিংটনের আদালত কক্ষে, বোর্ডরুমে, সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে এবং টেলিফোন ও সিগারেটের ধোঁয়ার চেয়ে বেশি কিছু নেই এমন নিউজরুমে। সত্তর দশকের টপসিক্রেট পেন্টাগন পেপার্সের প্রকাশনা নিয়ে ঐতিহাসিক ড্রামা ‘দি পোস্ট’-এ এমন সব দৃশ্যপটের আড়ালে রয়েছে সাংবাদিকতার প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা ও ভালবাসার অভিলাষ। গোটা ছায়াছবিতে প্রায়শই দেখা যাবে ধোঁয়াচ্ছন্ন নিউজরুমে রিপোর্টাররা গাদা গাদা নথিপত্রের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে সরকারের মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য প্রচারের নানা কাহিনী উন্মোচনের সূত্রগুলো আতিপাতি করে খুঁজছেন। অবশেষে এক সময় তাদের পরিশ্রমের ফসল সুস্পষ্ট অবয়ব লাভ করল। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন তাদের প্রণীত রিপোর্ট সিরিজ আকারে প্রকাশের জন্য ছাপাখানায় গেল এবং বেরিয়ে এলো নিদারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী শিরোনাম নিয়ে। গোটা আমেরিকাতে মহা-আলোড়ন পড়ে গেল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ক্রিয়াকলাপের কথা আমেরিকার মানুষ যতটা জানত তার চেয়েও অনেক ব্যাপক পরিসরে ও অনুপুঙ্খরূপে তুলে ধরা হয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। আর ‘দি পোস্ট’ সিনেমাটি সেই পেন্টাগন পেপার্সের চলচ্চিত্রায়নিক বর্ণনামাত্রা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। কারণ, পেন্টাগন পেপার্সের কাহিনীর একটা বড় অংশজুড়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কর্মকা-ের বিবরণ থাকলেও ‘দি পোস্ট’ ছবিটি শেষ অবধি দর্শকদের আরও বড় ও আরও চাঞ্চল্যকর কাহিনীতে নিয়ে গেছে। আর সেটা হলো দু’জন রিপোর্টারের তথ্যানসন্ধানের মধ্য দিয়ে ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কার্যালয়ে আড়িপাতা ঘটনা উন্মোচনের কাহিনী। অর্থাৎ ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কাহিনী। ওয়াশিংটন পোস্টের এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো পত্রিকার কপির অভ্যন্তরে প্রবল উত্তাপ ধারণ করে ফুটপাথের নিউজ স্ট্যান্ডগুলোতে চলে এসে হটকেকের মতো পাঠকের হাতে হাতে ফেরে। আলোড়ন ওঠে আমেরিকাজুড়েই শুধু নয়, বিশ্বজুড়েও। ওয়াশিংটন পোস্টের এই কাহিনীগুলোর উত্তাপ ও প্রভাব ছায়াছবিতেও অনুভব করা যাবে। ওতে স্পিলবার্গ এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, একটা পরিবর্তন আসছে এবং সেই পরিবর্তনটা সাংবাদিকদের পরিশ্রমের ফল। সংবাদপত্রের প্রতি স্পিলবার্গের ভালবাসা প্রচলিত প্রথা ও ফ্যাশনবিরুদ্ধ। আজ সর্বাধিক নজরকাড়া সংবাদগুলো প্রথমে ছাপাখানার মধ্য দিয়ে নয়, বরং ওয়েব সার্ভারের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এর মধ্যে অনেক সংবাদেরই বস্তুনিষ্ঠতা থাকে না। ফলে বর্তমান যুগে ওভাল অফিস থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক পর্যায় পর্যন্ত অনেকেরই অনাকাক্সিক্ষত খবরকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা কাজ করে। এ অবস্থায় পেন্টাগন পেপার্সের মতো সমপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলোর প্রত্যাশিত প্রভাব না রাখতে পারার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকার ইতিহাসে মানুষের মনোরঞ্জনের দীর্ঘতম ট্র্যাক রেকর্ডের অধিকারী স্পিনবার্গের মতো একজন চলচ্চিত্রকার এমন এক পেশাকে নিয়ে ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন যে পেশা সম্পর্কে জনসাধারণের একটা বড় অংশের মনে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস। ‘দি পোস্ট’ ছায়াছবিটি এমন এক পত্রিকা অফিসকে তুলে ধরেছে যেখানে আছে ব্যক্তিত্বের ছড়াছড়ি। কেউ বেশি বিখ্যাত, কেউ কম, আবার কেউ স্বল্প পরিচিত হলেও অল্পদিনের মধ্যে তারকাখ্যাতি পেয়ে গিয়েছিল। ছবির চরিত্রগুলো সবই বাস্তব। সেখানে আছেন বিশাল ক্যারিশমার অধিকারী সম্পাদক বেন ব্রাডলি, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টম হ্যাঙ্কস। পোস্টের প্রকাশক ক্যাথারিন গ্রাহামের চরিত্রে রূপদান করেছেন মেরেল স্ট্রিপ। পেন্টাগন পেপার্স বের হওয়ার সময়টিতে গ্রাহাম তার পরিবারের মিডিয়া ব্যবসার কর্ণধার হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। আর বেন ব্রাডলি তো লব্ধপ্রতিষ্ঠ সম্পাদক। পেন্টাগন পেপার্সের ওপর সিরিজ রিপোর্ট ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সঠিক সময় সঠিক কাজটাই করেছিলেন। তবে সে মুহূর্তে সিদ্ধান্তটা যে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে গ্রাহাম এ সংক্রান্ত বিতর্কের কারণে ব্যবসার ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর পত্রিকার সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রাডলি এই কাহিনী ছাপতে আগ্রাসী রূপ ধারণ করে অগ্রসর হয়েছিলেন, যদিও এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, এর পরিণতিতে তাকে ও গ্রাহামকে কারাগারে ঠাঁই পেতে হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সংবাদপত্রকে তো বটেই, এমনকি সরকারের অন্যায় কার্যকলাপ ও ভুল-ভ্রান্তি উন্মোচনে সাংবাদিকদের ক্ষমতাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। সাংবাদিকদের তিনি বলতেন মিথ্যাবাদী। আর তাদের দাবিয়ে রাখতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। তথাপি শেষ রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অর্থবহ নানা দিক দিয়ে শেষ অবধি গ্রাহাম ও ব্রাডলিরই জয় হয়েছিল। স্পিলবার্গ তার এই ছবিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনেকটা বন্ড কাহিনীর ভিলেনরূপে চিত্রিত করেছিলেন। আর এমন এক ভিলেনের প্রতিপক্ষ সম্পাদক হিসেবে যা হওয়া উচিত তেমন এক তুখোড় সম্পাদক ব্রাডলির ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন টম হ্যাঙ্কস। ছবিতে ব্রাডলি যে অপ্রতিরোধ্য আদর্শবাদ ও অনুপ্ররেণাদায়ক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা আর কোন কাহিনী বা চরিত্রে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ‘দি পোস্ট’ কাহিনীর প্রথম দিকের একটি দৃশ্যে আছে যে, হোয়াইট হাউস প্রেসিডেন্টের কন্যার বিবাহের খবর পরিবেশনের জন্য গতানুগতিক রিপোর্টারের বাইরে ভিন্ন এক রিপোর্টারকে দায়িত্ব দেয়ার দাবি জানালে ব্রাডলি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্রেফ তা মেনে নিয়ে ঝুট-ঝামেলা এড়াতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ঘোষণা করেন ‘আমরা কি ছাপব না ছাপব তা প্রশাসন ঠিক করে দেবে এটা হতে দিতে পারি না।’ আপোসহীন ও একগুঁয়ে স্বভাবের ব্রাডলি তার পত্রিকায় শুধু পেন্টাগন পেপার্স ছাপিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিও উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। যার পরিণতিতে নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল। ‘দি পোস্ট’ ছায়াছবিটি বিজয়ের এক নতুন প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। সংবাদপত্রের ভূমিকা এখানে মহিমান্বিতরূপে তুলে ধরেন স্পিলবার্গ। বেন ব্রাডলি তার দৃষ্টিকল্পে সংবাদপত্রকে সরকারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা করায়ত্ত করার পথে বাধা হিসেবে দেখলেও নানা কারণে এই সংবাদপত্র আজ আগের যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি হুমকির সম্মুখীন। তারপরও বলতে হয় যে, স্পিলবার্গের ‘দি পোস্ট’ ছায়াছবিটি সাংবাদিকতার ওপর এক অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র। একই সঙ্গে এটা এমন এক রমরমা, ক্রুব্ধ ও আবেগপ্রবণ ছবি যা একমাত্র স্পিলবার্গই বানাতে পারেন। চিত্রনাট্য ও কাহিনীতে কোন ইমপিচমেন্ট, গুপ্তহত্যা বা পদত্যাগের ঘটনা থাকুক আর না-ই থাকুক ছবিটি আমাদের সময়কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছায়াছবি হিসেবে বিবেচিত হবে বলে সমালোচকরা মনে করেন। -টাইম ও হিন্দুস্থান টাইমস অবলম্বনে
×