ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুধবার টেকনাফ উপকূল দিয়ে নতুন এসেছে দু’শতাধিক

উগ্র বৌদ্ধদের সহিংসতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

উগ্র বৌদ্ধদের সহিংসতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য নতুন আঙ্গিকে উত্তপ্ত হয়েছে। হাজার হাজার মারমুখী বিক্ষুব্ধ বৌদ্ধদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। এ রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাখাইনদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর এমন পরিস্থিতিতে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মুসলিমরা সে দেশে ফিরে গেলে কি অবস্থা হবে তা নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গত মঙ্গলবারের এ ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এসেছে বুধবার। ঘটনাটি ঘটেছে রাখাইন রাজ্যের ম্রাউক-উ শহরে। হাজার হাজার বৌদ্ধদের এ বিক্ষোভের নেপথ্যে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে তার বিরুদ্ধে। আরও কারণের মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধদের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসবের ওপর মিয়ানমার সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করাকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা যাই হোক, উত্তপ্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আগে এ ধরনের ঘটনা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গারা এ ধরনের ঘটনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। এদিকে, মিয়ানমারের নেপিডোতে প্রত্যাবাসন চুক্তির খবরে রাখাইন রাজ্যে এখনও অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে এসে আশ্রয় নেয়ার জন্য এপারে আশ্রিতদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় খবর পাঠানো হচ্ছে। রাখাইনে গত ২৫ আগস্ট রাত থেকে অভিযান শুরু হওয়ার পর বুধবার পর্যন্ত চার মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য উভয় দেশে প্রস্তুতি চলছে। এ অবস্থায় বুধবার ভোরে রাখাইনের বুচিদং থেকে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফের সদর মহেশখালীয়া পাড়া সৈকত পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করেছে। তারা টেকনাফ বাস স্টেশনে এসে জড়ো হলে টেকনাফ থানা পুলিশ রেজিস্ট্রেশন তালিকায় লিপিবদ্ধ করে সকলকে বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছে। বুচিদং থানার ছিনদিপ্রাং গ্রামের রোহিঙ্গা আবু ছৈয়দ, সনজিদা বেগম, হোছন আহমদ ও পুঁইমালি গ্রামের ফয়েজুর রহমান জানান, বাংলাদেশে আশ্রিত স্বজনরা মুঠোফোনে জানিয়েছে, মিয়ানমারে মগের মাইর (অত্যাচার) খাওয়ার চেয়ে এখানে এসে মরা ভাল। এছাড়া এখানে ফ্রি রেশন, ত্রাণ সামগ্রী ও চিকিৎসা সেবার মোটেও অভাব নেই জানিয়ে স্বজনরা তাড়াতাড়ি এপারে চলে আসতে তাগিদ দিয়েছে। মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী এপারে আসতে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা করেনি উল্লেখ করে তারা আরও জানান, নিজ দেশে রোহিঙ্গা পরিবারের লোকজন বেশি নেই। এ জন্য সেখানে কোথাও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। একদিকে অজানা আতঙ্ক, অপরদিকে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে ঘরে দিনাতিপাত করেছি। তাই এপারে আশ্রয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। জনপ্রতি ৫০ হাজার কিয়াতের বিনিময়ে নৌকায় করে এপারে ঢুকেছি জানিয়ে রোহিঙ্গা নারী সনজিদা বেগম বলেন, সেখানে সরকারী কাজে শ্রম দিলেও মজুরি দেয়া হয়না। তার স্বামীকে সেনারা ধরে নিয়ে ১০ দিন ধরে কাজ করিয়ে কোন পারিশ্রমিক দেয়নি। ঘরের ছেলে মেয়েদের নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে ছিলাম। কাজ কর্ম না থাকায় চরম খাদ্য সঙ্কটে থেকেছি। শেষে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এদেশে আশ্রয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। তারা বলেন, স্বজনদের মধ্যে আগে যারা অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ করে সীমান্ত পার হয়েছি। স্বদেশে যদি চলে যেতে হয়, আগে যারা এসেছে তারাই যাবে। আমরা পরে দেখব বলে জানায় অনুপ্রবেশ করা নতুন রোহিঙ্গারা। অস্ত্রসহ দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক ॥ র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে। বুধবার ভোররাতে উখিয়ার কুতুপালং কচুবনিয়া গ্রামের জনৈক ফরিদ আহমদের বাড়ির সামনে থেকে তাদের আটক করা হয়। আটক রোহিঙ্গারা হচ্ছে- আব্দুর রহমান প্রকাশ জাবের ওরফে জাবেদ ও মোঃ সেলিম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১টি এসবিবিএল, ১টি রামদা, ১টি কিরিচ এবং ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। শেড ব্লকে গোল বৈঠক ॥ রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়ে মঙ্গলবার মিয়ানমারের নেপিডোতে চুক্তির খবরে টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রিত ক্যাম্পের প্রতিটি শেড ব্লকে স্বদেশে ফিরে যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোল বৈঠক চলছে। বুধবার সকাল থেকে কয়েকজন মিলে তাদের ব্লকের সামনে শুধুই স্বদেশে ফেরত যাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ওই আলোচনায় রোহিঙ্গারা একমত পোষণ করেছে যে তাদের বাড়িঘর ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে যাবে না। এখানে কতিপয় পুরনো রোহিঙ্গা নেতা ও এক শ্রেণীর এনজিও কর্মী স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের রাজি না হতে প্ররোচনা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ষড়যন্ত্রকারীরা একটি বাক্য রোহিঙ্গাদের মনে বিশ্বাস জমিয়ে দিয়েছে যে কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে না চাইলে প্রশাসন তাদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠাবে না। এজন্য রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে রাজি হবেনা বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলাদেশের মাটিতে দীর্ঘস্থায়ী থেকে রোহিঙ্গারা আন্দোলন করলে তাদের বাড়িঘর ফিরে পাবেনা। যাদের নামে তালিকা প্রস্তুত হয়েছে, ওসব রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা সরকারকে কঠোর হস্তে নিতে হবে। তাদের নামে বরাদ্দকৃত রেশন কার্ড প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তা না হলে রোহিঙ্গারা কোন দিন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হবেনা। রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়ে নেপিডোতে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও রোহিঙ্গারা তাদের দাবি পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা জানায়, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থার অংশগ্রহণ, মিয়ানমারের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো রোহিঙ্গাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধকরণ, সেনাতা-বে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সম্পদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার প্রশাসনের আনীত সব বানোয়াট অভিযোগ প্রত্যাহার করে কারাবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান, মানবতা বিরোধীকর্মকা-ে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, প্রত্যাবাসনের আগে রাখাইনে জাতিসংঘ মিশনের সেনা প্রেরণ এবং সম্পদ-সম্পত্তি ও জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে রাখাইন রাজ্যে ফেরত যাবে তারা। প্রত্যাবাসন চুক্তি-স্থানীয়দের অভিমত ॥ টেকনাফ ও উখিয়ায় ১২টি অস্থায়ী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হওয়ায় স্থানীয় অধিবাসীরা খুশি। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার অধিবাসীরা অতি দ্রুত সকল রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফেরতের ব্যবস্থা নিতে দাবি জানিয়েছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, উখিয়া-টেকনাফ দুই উপজেলায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার কারণে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বুধবার জনকণ্ঠকে জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। স্থানীয়রাও রোহিঙ্গাদের বাসস্থানসহ নিরাপত্তায় যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। যার যতটুকু সাধ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয়রা। তখন রোহিঙ্গাদের প্রতি এক প্রকার সহানুভূতি কাজ করেছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ফেরতের চুক্তি হয়েছে, সকল রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত প্রদানে সরকার ব্যবস্থা নেবে এটিই কাম্য। কারণ রোহিঙ্গারা এখানে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তা বাদ দিয়ে কখনও মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে না। এটি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রত্যাবাসনের কৌশল বের করতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
×