ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিডিএফ সম্মেলনে দেশী-বিদেশী নীতি নির্ধারকদের অভিমত

’৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পেতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

’৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পেতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) সম্মেলনে দেশী-বিদেশী নীতি নির্ধারকরা বলেছেন, মধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় জায়গা করে নিতে হলে বেসরকারী খাতের ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাই সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চগতি ধরে রাখতে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। এ জন্য বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হবেন। তবে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা, বিদেশী বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়, রফতানি বৈচিত্রকরণ, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের পরিসর বাড়ানো ও পণ্যের উচ্চতর গুণমান নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীরা। বুধবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী বিডিএফ-২০১৮ সম্মেলনের ‘ক্রিয়েটিং এন এ্যানাবলিং এনভায়রনমেন্ট ফর এফডিআই এ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টর গ্রোথ’ শীর্ষক অধিবেশনে আলোচকরা এমন মত দেন। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে ছিলেন জাপানভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী জাইকার ডিরেক্টর জেনারেল কেইচিরো নাকাজাওয়া, আইএফসির সিনিয়র ইকোনমিস্ট এ্যান্ড প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. এম মাসরুর রিয়াজ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির, অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ শহীদুল হক এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট নিহাদ কবির। উল্লেখ্য, বিডিএফ একটি উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্ট, যেখানে সরকার তার উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য আরও অংশীদারিত্ব আবিষ্কার করতে কাজ করে। তৃতীয়বারের মতো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এ সম্মেলনে জাপান, নেদারল্যান্ডসসহ ৩৬টি দাতা সংস্থা ও দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এই সম্মেলনে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোকেই প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার। মূল প্রবন্ধে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা দুটো লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি- ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া এবং ২০৩০ সাল মেয়াদী টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা। এ দুটো লক্ষ্য অর্জনে বেসরকারী বিনিয়োগ অন্যতম ভূমিকা রাখবে। তাই আমরা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ এবং বিদেশী বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষগুলোর (বিডা, বেজা, হাইটেক পার্ক অথোরিটি, পিপিপি অথোরিটি) মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। এফডিআই বাড়াতে ইতোমধ্যে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে আমাদের বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৩ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে আমাদের সক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এ সক্ষমতা আরও বাড়বে। ২০২১ সালের মধ্যে ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দুই অঙ্কের ঘরে (বর্তমান অবস্থান ১৭৬) নিয়ে আসার টার্গেট সরকার নিয়েছে। পাশাপাশি একই সময়ে দেশের প্রবৃদ্ধিও ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশের ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে জাইকার ডিজি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে আগামী তিন বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশের ঘরে থাকবে, যা চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল বিজনেস কমপিটেটিভনেস সূচকেও বাংলাদেশর অবস্থান ভাল। তাই বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বিদেশী বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য। তবে ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশ কম এফডিআই পাচ্ছে বলে মনে করেন কেইচিরো নাকাজাওয়া। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির উচ্চ গতি ধরে রাখতে বাংলাদেশকে টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে ইপিজেডগুলো ভাল দৃষ্টান্ত। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে তিনি রফতানি বৈচিত্রকরণ ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন। ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে ২০ লাখ তরুণ-তরুণী প্রবেশ করছে। তাদের জন্য কোয়ালিটি জব তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তবে বেসরকারী খাতে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এজন্য সরকারকে এফডিআইয়ের সঙ্গে স্থানীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে সম্পৃক্ত করা নীতি কৌশল অবলম্বন করতে হবে। স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরের মতে উন্নত বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে বেসরকারী খাত। এজন্য প্রযুক্তিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে কর্মসংস্থান, স্থানীয় চাহিদা পূরণ এবং রফতানি- এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক রাজনীতি একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বিদেশী বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের সব সম্ভাবনাই এক্ষেত্রে রয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মানবিক দেশ হিসেবে সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করছে। কৃষক ও সরকারের নিজস্ব উদ্ভাবনে দেশের কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে ॥ কৃষি বিষয়ক বিডিএফের অপর একটি অধিবেশনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, কৃষক ও সরকারের নিজস্ব উদ্ভাবনে দেশের কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে গবেষণার বিভিন্ন ধাপে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, কৃষক নিজেরাই জাত উদ্ভাবন করছে। আমরা নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে গবেষণার বিভিন্ন ধাপে উন্নয়ন সহযোগীরা সহায়তা করবে বলে আশা করছি। বিল্ডিং রেজিলেন্স ইন এগ্রিকালচার এ্যান্ড এক্সট্রিম ক্লাইমেট কন্ডিশন শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমরা সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে দূর করেছি। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ওইসব দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সফলতার সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছি। ক্ষুদ্র কৃষকের উন্নয়নে সরকার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা প্রদান করছে। সে লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে কৃষক ক্লাব গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কৃষকের সব সেবা সহজলভ্য। তিনি বলেন, গ্রামীণ নেটওয়ার্ক এখন খুব ভাল। সমস্যা আছে, তবে তা জটিল নয়। কৃষককে বীজ, সার ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। আমরা আমাদের উন্নয়নে প্রস্তুত রয়েছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুলাহ বলেন, কৃষি খাতে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ জড়িত। জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, সাইক্লোন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির গভীরতা নিচের দিকে নামছে। নীতিগত চ্যালেঞ্জের কথা উলেখ করে তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধের করণীয় সম্পর্কে এখনও আমাদের তেমনভাবে জানা নেই। বিসিএএস’র নির্বাহী পরিচালক ড. এ আতিক রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনন আমাদের ঘিরে রেখেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের রাজধানী হওয়া উচিত। এতে বক্তব্য রাখেন সুইজারল্যান্ডের এম্বাসেডর এইচ ই রেনি হোলেসটিন, এফএও’র এক্টিং কান্ট্রি ডিরেক্টর ডেভিড ডোলান, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুলাহ আল মহসিন চৌধুরী। এর আগে সকালে উদ্বোধনী অধিবেশনের পর সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম মূল প্রবন্ধ উপস্থান করেন। এতে তিনি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি কী এবং এসডিজি অর্জনে দাতাদের প্রত্যাশিত ভূমিকা কি তা তুলে ধরেন।
×