ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার ভুলতার গাউসিয়া

গভীর রাতে শুরু, ভোরে শেষ- ভাগ্য ফিরছে দরিদ্র নারীর

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

গভীর রাতে শুরু, ভোরে শেষ- ভাগ্য ফিরছে দরিদ্র নারীর

মীর আব্দুল আলীম বাড়ির কাছে আরশিনগর...। রাজধানী ঢাকার পূর্বে একবারে সদর দরজার কাছে ভুলতার গাউসিয়া হাটে অভাবনীয় বাণিজ্যের ধুন্ধুরাম কা- ঘটে চলেছে সেই বহু বছর ধরে। কথায় আছে, ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীর’ হাট বসে এখানে। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সারাদেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের বিপণন-তীর্থ হয়ে ওঠে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের এই মোকাম। প্রায় তিন যুগের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে এই বস্ত্র-হাট। অলিগলি আলো-আঁধারিতে কয়েক হাজার দোকান! বিস্ময় জাগে যে, হাটবারে হাজারো ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। ব্যবসায়ীদের জন্য এখানে দিন-রাতের ফারাক থাকে না। ফুরসত মেলে না নাওয়া-খাওয়া-ঘুমের। সপ্তাহের একদিন বিক্রি-বাট্টা হয় অবিশ্বাস্য অংকে। শুধু মঙ্গলবার- এক দিনেই এখানে বিক্রি হয় প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল। আর এ হাটের ক্রেতা সব নারী। এ হাটকে ঘিরে সারাদেশের ৩০ হাজার নারীর ভাগ্যের চাকা সচল হয়েছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নিশুতি রাতের নিস্তদ্ধতায় শুরু হয় এই হাটের হাঁক-ডাক। দরদামের কোলাহল, কুলিদের ব্যস্ততা। মার্কেটের সামনে ভ্যানের দীর্ঘ সারি। হাটের গা-ঘেঁষে সড়কে ট্রাকের বহর। কাপড়ের বিশাল গাঁট উঠছে, নামছে। লোড নিয়ে চলেছে দূর-দূরান্তের গন্তব্যে। সেই ১৯৭৯ সাল থেকে আজ অব্দি ব্যবসায়ের কৌলিণ্য বেড়ে যাওয়ায় এই হাটকে ইতোমধ্যে ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ উপাধি দেয়া হয়েছে। গাউসিয়া মার্কেটের থান কাপড়ের ভাঁজে-ভাঁজে রঙের গন্ধ। বেশি ক্রেতা, বেশি বিক্রি। এর বাইরে আর কোন দৃশ্য নেই। একসময় কেবল শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও চাদরের জন্য যে গাউসিয়া হাটের সুখ্যাতি ছিল তার বর্ণাঢ্য এখন প্রশস্ত হয়েছে। বর্তমানে এই হাট দেশের বড় তাঁতবস্ত্র বিপণন কেন্দ্র। রুমাল থেকে জামদানি শাড়ি, মাথার টুপি থেকে পাঞ্জাবি সব মেলে এই হাটে। ছাপা কাপড়, থান কাপড়, সুতি কাপড়, থ্রি-পিস, ওড়না, শার্ট-প্যান্ট কি নেই এখানে। রমজানের ঈদে বাড়তি যোগ হয় যাকাতের কাপড়। চট্টগ্রাম, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, ভোলা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের সব প্রান্তের পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর গাউসিয়া হাট। ব্যবসায়ীদের কোন টোল জমা, খাজনা, বা চাঁদা দিতে হয় না। টোল-খাজনা না থাকায় গাউসিয়া হাটই ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ। তাছাড়া চোর-বাটপাড় কিংবা ছিনতাইকারীর কোন ভয় নেই। কোন এক মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটা তখন ভোর সাড়ে ৫টা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নীরব-নিথর। অল্প কিছু দূরে দূরে কয়েকজন করে মহিলার জটলা। এদের কেউ বোরকা পরা। কেউ কাপড় পরা। কারও হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। আবার কারও হাতে চটের বস্তা। এদের কারও বাড়ি যশোর। কারও বাড়ি নোয়াখালী। কারও বাড়ি চট্টগ্রামে। আবার কারও বাড়ি জামালপুর, পটুয়াখালীতে। দারিদ্র্য তাদের অভিশাপ। তাই দারিদ্র্যকে জয় করতে এরা একেক জন জীবনযুদ্ধ আর জীবিকা নির্বাহের অগ্রনায়িকা। এরা সবাই আজ স্বাবলম্বী। প্রতি মঙ্গলবার সারাদেশের প্রায় ৩০ হাজার নারী রূপগঞ্জের গাউসিয়া মার্কেটে এসে সমবেত হয়। গাউসিয়া মার্কেট এদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ভুলতা গাউসিয়া মার্কেট দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার। এ মার্কেট এখন বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। শুধু মঙ্গলবারে পাইকারি কাপড় বিক্রি হয় প্রায় ২০ কোটি টাকার। মার্কেট কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে ভুলতা এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে গাউসিয়া মার্কেট। ১৯৭৯ সালে ছোট পরিসরে বেচাকেনা শুরু হয়। পরে ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি গাউসিয়া মার্কেটের প্রথম ভবন গড়ে ওঠে। পরে ধীরে ধীরে ১২০ বিঘা জমির ওপর মার্কেট সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে গাউসিয়া-১ ও গাউসিয়া-২ মার্কেটে পাইকারি কাপড়, শাড়ি, ওড়না, লুঙ্গি, গামছা বিক্রি হয়। সরেজমিনে ঘুরে নারী ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে অভাবীদের দারিদ্র্য জয়ের নানা গল্পের তথ্য মিলেছে। সকাল ৬টায় মার্কেটের ভেতরে কথা হয় ষাটোর্ধ শরফুন বেগমের সঙ্গে। স্বামী এহান আলী ৫ বছর আগে মারা গেছে। বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহের গোয়ালপাড়া এলাকায়। গত ২০ বছর ধরে গাউসিয়া মার্কেট থেকে পাইকারি কাপড় কিনে নিয়ে এলাকায় ফেরি (ঘুরে ঘুরে ) করে বিক্রি করেন। এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাত। এখন সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। শরফুন বেগম বলেন, বাজান এহানতে কাপড় কিনা ভালাই আছি। দামে কম পাই। আর নাইলে কি হেই জামালপুরতে আহি। প্রায় ১৮ বছর আগে মারা যায় স্বামী আব্দুল করিম। স্বামী মারা যাওয়ার পর চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খায়। অবশেষে এলাকার শরফুন বেগমের পরামর্শে গাউসিয়া থেকে কাপড় কিনে নিয়ে এলাকায় বিক্রি করতে থাকে জুলেখা বেগম। আজ সে স্বাবলম্বী। কাপড়ের ব্যবসা করে সংসার চালানোর পাশাপশি তিন শতাংশ জমি কিনেছেন। জুলেখা বেগম বলেন, আল্লায় ভালাই রাখছে বাজান। সোয়ামী মইরা যাওনের পরে দিশাহারা অইয়া গেছিলাম। শরফু বুবু আমারে পথ দেহাইছে। আমি অহন ভালা আছি। এহানকার কাপড়ের দাম কম। কিনা লাব (লাভ ) পাই। পটুয়াখালী আদালত পাড়ার নুরজাহান বেগম। আদালত পাড়ার লঞ্চঘাটেই তার কাপড়ের দোকান। প্রতি সোমবার লঞ্চে ছুটে আসেন ঢাকায়। এরপর আসেন গাউসিয়া মার্কেটে। সপ্তাহে ১০/১৫ হাজার টাকার কাপড় কিনে নেন। নুরজাহান বেগম জানান, ভালাই আছি। ১০ হাজার টেকার কাপড় নিলে লাভ ভালাই অয়। অন্যহান থেইক্যা কাপড় কিনলে লাভ অয় না। হের লেইগ্যাই এহান থেইক্যা কাপড় কিনা নেই। কাপড় কিনে বের হওয়ার সময় কথা হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে আসা হুসনে আরা বেগমের সঙ্গে। স্বামী আলী আহাম্মদ রিকশাচালক। স্বামীর আয়ের টাকায় সংসার চালানো দায়। তাই পাশের বাড়ির জেসমিন আক্তারের পরামর্শে গাউসিয়া থেকে কাপড় কিনে নিতে এসেছেন। হুসনেআরা বেগম বলেন, ভাই ভালাই আছি। সংসার চালাইতে গিয়া অনেক কষ্ট করছি। অহন ডাইল-ভাত খাইবার পারি। যশোহর জেলার রহিমপুর এলাকার কামালউদ্দিনের সঙ্গে খায়রুন বেগমের বিয়ে হওয়ার পর অভাবের তাড়নায় ৯ বছর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে এসে বসবাস শুরু করে। এরপর স্বামী তাকে ফেলে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। কোন উপায় না পেয়ে বাসা বাড়িতে কাজ নেয় খায়রুন বেগম। একসময় গলার চেন বিক্রি করে গাউসিয়া মার্কেট থেকে শাড়ি, ওড়না, গামছা কিনে নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করে। এখন সে স্বাবলম্বী। খায়রুন বেগম বলেন, গাউসিয়া মার্কেট আমার ভাগ্যের চাকা ফিরাইয়া দিছে। আর কাপড়ের দাম অনেক কম। এদের মতো মুন্সীগঞ্জের করিমন বেগম, সিলেটের আঙ্গুরবালা, ঢাকার রায়েরবাগের মনি বেগমসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩০ হাজার নারী প্রতি মঙ্গলবার গাউসিয়া মার্কেট থেকে পাইকারি কাপড় কিনে নিয়ে যায়। এদিকে গাউসিয়া মার্কেটের দোকান মালিকরা জানান, গাউসিয়া মার্কেটে পাইকারি কাপড়ের দোকান রয়েছে সাড়ে ৪ হাজারের ওপরে। তবে এসব দোকান সবগুলো খোলা থাকে মঙ্গলবার। অন্যদিনগুলোতে কিছু দোকান বন্ধ থাকে। মঙ্গলবারে একেকটি দোকানে বিক্রি হয় কমপক্ষে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। আবার কোন কোন দোকান ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি করে। শাড়ি-কাপড় বিতানের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, ভাই ব্যবসা ভালাই। তয় দেশের পরিস্থিতি খারাপ অইলে ব্যবসা মন্দা হয়। আমাগো কাস্টমার সব মহিলা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেইক্যা আহে। তাই পরিস্থিতি খারাপ অইলে মনডা খারাপ অইয়া যায়গা। আগে বেচবার পারতাম দেড়-দুই লাখ টাকা। অহন বেচি মাত্র ৪০-৫০ হাজার টাকা। সিটি প্রিন্ট শাড়ির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগে বেচবার পারতাম লাখ পাঁচেক টাকা। আর অহন বেচবার পারি লাখখানেক টাকা। মাইনসের হাতে টেকা নাই। আরেক ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান জানান, প্রতি মঙ্গলবারে সাড়ে ৪ হাজার পাইকারি দোকানদার এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার বেচাকেনা করে। সে হিসাবে প্রায় মঙ্গলবারে ৪০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। মার্কেটের ম্যানেজার আব্দুল আউয়াল বলেন, মার্কেটে সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার নারী ক্রেতা আসে এটা ভাগ্যের বিষয়। তাই নারী ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। যেন ছিনতাই, চুরি কিংবা ডাকাতির ঘটনা না ঘটে। মার্কেটের পাশেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। তাছাড়া রয়েছে নিরাপত্তা প্রহরী। মার্কেটের মালিক মুস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু বলেন, গাউসিয়া মার্কেটের ৮০ ভাগ ক্রেতাই মহিলা। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব নারী কাপড় কিনতে আসেন তাদের অনেক কষ্ট হয়। সেই বিবেচনা মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা করেছি গাউসিয়ায় একটি মহিলা রেস্ট হাউস তৈরি করব। কম খরচে মহিলারা এখানে রাত যাপন করতে পারবে। আর ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে মার্কেটের পাশেই তৈরি করা হবে এ্যাপার্টমেন্ট।
×