ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা উত্তর সিটি ভোটে তিন মাসের স্থগিতাদেশ ;###;বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চের রায় ;###;তফসিল কেন আইনবহির্ভূত নয় জানতে চেয়ে রুল

মেয়র নির্বাচন স্থগিত ॥ হাইকোর্টের রায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৮

মেয়র নির্বাচন স্থগিত ॥ হাইকোর্টের রায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তফসিল ঘোষণার ৮ দিনের মাথায় স্থগিত হয়ে গেলো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদের উপনির্বাচন এবং সম্প্রসারিত ১৮ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন। বুধবার আদালত তিন মাসের জন্য এই নির্বাচনের উপর স্থগিতাদেশ করেছে। পৃথক দুটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে ওই নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করেছে। এদিকে হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমাদ সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের কপি হাতে পেলে নির্বাচনী কার্যাবলি সম্পর্কে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। তবে তিনি এও উল্লেখ করেন আইনী বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনের তফসিল, সার্কুলার ঘোষণা করা হয়। কমিশন আইনের প্রতি সব সময় শ্রদ্ধাশীল। তিনি জানান, উত্তরের মেয়র পদের উপনির্বাচন এবং সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচন স্থগিত হলেও দক্ষিণের ১৮ ওয়ার্ডের এবং সংরক্ষিত ৬টি ওয়ার্ডের কান্সিলরর পদে নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন এবং দুটি সিটিতে সম্প্রসারিত ৩৬ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। গত ৯ জানুয়ারি এ দুটি সিটিতে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেন তিনি। তফসিল ঘোষণার ৮ দিনের মাথায় আদালতের আদেশে উত্তর সিটি নির্বাচনের স্থগিতের ঘোষণা আসলো। তবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৮ ওয়র্ডের নির্বাচনের বিষয়ে এখনো কোন স্থগিতাদেশ দেয়া হয়নি। তবে এ বিষয়ে আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দুটি সিটিতে মেয়র এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য ইসির পক্ষ থেকে তফসিল ঘোষণা করা হলেও আইনী জটিলতা থাকায় নির্বাচন আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে আগ থেকেই সন্দেহ ছিল। খোদ তফসিল ঘোষণা অনুষ্ঠানে আইনগত জটিলতার বিষয়ে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, কেউ যদি মামলা করে তাহলে ইসির কি করার আছে। উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে গত ১ ডিসেম্বর থেকে পদ শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। আইন অনুযায়ী পদ শূন্য ঘোষণার ৩ মাসের মধ্যেই নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। সে অনুযায়ী আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা ছিল। এছাড়া গত ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল মেয়র নির্বাচনের পর নতুন করে দুই সিটিতে ৩৬ নতুন ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত চার জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনের এক বৈঠকে উপনির্বাচনের পাশাপাশি দুই সিটির সম্প্রসারিত ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। গত ৯ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি এ দুটি সিটির সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের নির্বাচনের জন্য তফশিল দেয়া হয়। কিন্তু প্রথম থেকেই উপনির্বাচনের পাশাপাশি সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে আইনগত জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাকি মেয়াদের জন্য উপনির্বাচন পরিচালনা করা হলেও ওয়ার্ডের সাধারণ নির্বাচনের মেয়াদ কতদিনের হবে তা আইনে স্পষ্ট নেই। তবে ইসির পক্ষ থেকে উপনির্বাচনের মতো বাকি মেয়াদের জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করা হয় পুরো মেয়াদের জন্য। ফলে আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই তফসিল দেয়ায় আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এছাড়া উত্তর সিটি করপোরেশন ভোটার তালিকা নিয়েও আইনগত জটিলতা তৈরি হয়। বিশেষ করে আগামী ৩১ জানুয়ারি হালনাগাদকৃত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সম্প্রসারিত ওয়ার্ডে যারা ভোটার হবেন তারা ভোট দিলেও প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বাধার তৈরি হয়। তফসিলে মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন ধরা হয়েছে ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার। কিন্তু যারা ভোটার হবেন তারা ভোট দিতে পারলেও তালিকা প্রকাশ না করায় প্রার্থী হতে পারছেন না। এছাড়া উত্তর সিটিতে মেয়র পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সম্প্রসারিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। সাধারণ নির্বাচনের ভোটারদের মেয়র প্রার্থী পদে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রেও আইনগত জটিলতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় আইনগত জটিলতা থাকায় তফসিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং তফসিলের কার্যকারিতার ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ও বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম। তাদের মধ্যে আতাউর ভাটারা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, আর জাহাঙ্গীর বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাদের দুই ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারণে ওয়ার্ড হিসেবে যুক্ত করে নেয়া হয়েছে। আতাউর রহমানের পক্ষে হাইকোর্টে শুনানি করেন মোস্তাফিজুর রহমান খান ও আহসান হাবিব ভূঁইয়া। আর জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী ও মোঃ জাহাঙ্গীর হোসাইন সেলিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মোখলেছুর রহমান। রিটকারী পক্ষ শুনানিতে বলে, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারির মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত ভোটার তালিকাই প্রকাশ করা হয়নি। আহসান হাবিব ভূঁইয়া যুক্তি দেন, এখন যিনি প্রার্থী হবেন, তিনি কিন্তু জানেন না তিনি ভোটার কিনা। তাছাড়া মনোনয়নপত্রে ৩০০ ভোটারের স্বাক্ষর থাকতে হবে। ভোটার তালিকা প্রকাশ না হলে সেটা কীভাবে সম্ভব?” তাই পুরো বিষয়টি রিটে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আহসান হাবিব ভূঁইয়া আরও বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন যুক্ত হওয়া ১৮টির ওয়ার্ড ধরলে কাউন্সিলরের সংখ্যা পঁচাত্তর শতাংশ হয় না। কারণ নতুন ১৮টিতে তো নির্বাচনই হয়নি। সে হিসাবে মেয়র পদই তো গঠিত হচ্ছে না। তাছাড়া সম্প্রসারিত ১৮টি ওয়ার্ডে যারা কাউন্সিলর হবেন, তারাও পুরো পাঁচ বছর থাকতে পারবেন না। অথচ সেখানে কিন্তু উপ-নির্বাচন হচ্ছেনা। এ বিষয়গুলো মূলত রিটে তুলে ধরা হয়। তিনি জানান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৫ (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, মেয়রের পদসহ করপোরেশনের শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং নির্বাচিত কাউন্সিলরগণের নাম সরকারী গেজেটে প্রকাশিত হইলে, করপোরেশন, এই আইনের অন্যান্য বিধানসাপেক্ষে, যথাযথভাবে গঠিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে। তাছাড়া সম্প্রসারিত ৩৬টি ওয়ার্ডে যারা কাউন্সিলর হবেন, তারা পুরো পাঁচ বছর পাবেন না কেন সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয় ওই রিট আবেদনে। রায়েক কপি হাতে পাওয়ার পর ব্যবস্থা ॥ এদিকে নির্বাচনের উপর আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ইসি সচিব সাংবাদিকদের বলেন, আইনী বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। তিনি জানান, ওই নির্বাচন স্থগিত হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৬টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন যথাসময়ে হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ আরও বলেন, নির্বাচন করা ইসির দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এসব নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ পেয়েছে ইসি। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আইনী বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনের তফসিল, সার্কুলার ঘোষণা করা হয়। এখন নির্বাচন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে কি না, তা জানতে চাওয়া হলে ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে কমিশন গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছে। আদেশের লিখিত কপি পাওয়ার পর নির্বাচন বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। কমিশন সব সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এদিকে ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ভোটার তালিকা প্রস্তুত আছে। তালিকার সিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। হাইকোর্টে রিট আবেদনকারী গত সোমবার মনোনয়নপত্র নিতে এসেছিলেন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে। তাঁকে ভোটার তালিকার সিডি দেয়া হয়েছিল। ভোটার তালিকায় তাঁর নামও আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। উপনির্বাচন স্থগিত হওয়ায় অচলাবস্থা হবে না-স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপনির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের ফলে সংস্থাটির সেবাসহ সকল কার্যক্রম পরিচালনায় কোন অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। একই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আদালতের দেয়া আদেশের বিষয়ে অতি দ্রুত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে করণীয় নির্ধারণ করতে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। মোশাররফ হোসেন বলেন, আদালতের আদেশের কারণে ডিএনসিসি পরিচালনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে না। সেবার মানও ব্যাহত হবে না। কারণ আইন মেনে প্যানেল মেয়র করা হয়েছে। প্যানেল মেয়র তো ভালই চালাচ্ছেন। তবে মেয়রের পদ বেশি দিন খালি রাখা সম্ভব নয়। সে কারণে মেয়র মারা যাওয়ার পরপরই আমাদের দায়িত্ব ছিল পদটি শূন্য ঘোষণা করা। আমরা সেটা যথা সময়ে করেছি এবং তাদের নির্বাচন করার জন্য মতামত দিয়েছি। এখন যদি সীমানা নির্ধারণ না হয় বা ভোটার তালিকা হালনাগাদ না হয় সেটা তো আমাদের দায়িত্ব না। এটা নির্বাচন কমিশনের কাজ।
×