ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডি.লিট ডিগ্রী গ্রহণোত্তর ভাষণে প্রণব মুখার্জী

উপমহাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কেন বেশি- এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

উপমহাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কেন বেশি- এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন

স্টাফ রিপোর্টার/চবি সংবাদদাতা ॥ ভারতের সাবেক প্রথম বাঙালী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বলেছেন, ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে- এমন নজির পৃথিবীর খুব বেশি দেশে দেখা যায় না। যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের ত্যাগের ফলেই বাংলা আজ একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন আজ সে মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করছি, গণতন্ত্র দিয়েই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের প্রতি একটি বড় আঘাত নেমে আসে। সেটি হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-। আততায়ীর বুলেট যেমন ভারতের স্বাধীনতার পরপরই মাহাত্মা গান্ধীকে ভারত ও পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল, ঠিক তেমনই কেড়ে নেয়া হয় সর্বকালের সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই উপমহাদেশে এত রাজনৈতিক হত্যাকা- কেন তা গবেষণা করে বের করা প্রয়োজন। মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুর রব হল প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিশেষ সমাবর্তনে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রী গ্রহণের পর উপরোক্ত কথা বলেন প্রণব মুখার্জী। তিনি উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক হত্যাকা- প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের প-িতদের এর কারণ বের করা দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ একটা ইউনিট ছিল। একটি প্রশাসনের অধীনে ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এই বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকা- সংঘটিত হলো তার কারণও অনুসন্ধান করতে হবে। প্রণব মুখার্জী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে বলেন। প্রশ্ন দুটি হলোÑ কেন বার বার নেতাদের হত্যা করা হয় এবং কেন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে । চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার কয়েকবছর পরই এর ওপর একটি বড় আঘাত আসে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ শিক্ষক ও ১২ শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়েছে। তবুও এ বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে থাকেনি। এর আগে ১২টা ৫৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রণব মুখার্জী। এরপর অনুষ্ঠানস্থলে এসে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রণব মুখার্জী উপমহাদেশে একজন সফল এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ। অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান এ মহান নেতাকে ডিলিট উপাধি দিতে পেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গর্ববোধ করছে।’ এরপর প্রণব মুখার্জীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন উপ-উপচার্য ড. শিরিন আখতার। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বারক ও ডিলিট ডিগ্রীর সনদ তুলে দেয়া হয় তাঁর হাতে। ৩৮ মিনিট বক্তব্যের শেষে উপ-উপাচার্যের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি সংলগ্ন দেশগুলোর রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন এর কারণ কী, তা এই অঞ্চলের মানুষকে জানতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি আততায়ীর গুলিতে ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হলো। স্বাধীন দেশে অসংখ্য সমস্যা ছিল। দেশ গড়ার সমস্যা, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করার সমস্যা। সে সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে একটি জাতিকে প্রায় জন্মলগ্নের মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো। পৃথিবীর কোন দেশে এমন নজির বিরল। আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের বহু বছর পর আব্রাহাম লিঙ্কন নিহত হয়েছিলেন। প্রণব মুখার্জী বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরই জাতির পিতাদের হত্যা করা হলো। ব্রহ্মদেশে (মিয়ানমার) আউং সান সু চির পিতা জেনারেল আউং সান ব্রাশফায়ারে নিহত হলেন। ১৯৬০ সালে নিহত হলেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেলখানায় নিহত হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী নেতারা। পাকিস্তানে জিয়াউল হক নিহত হলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়া হলো। এত বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকা-ের কারণ এই অঞ্চলের মানুষকে জানতে হবে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক শাসন চলেছে। এখন গণতন্ত্র আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে সামরিক শাসক আসে। হিংসাত্মক এই রাজনৈতিক হত্যাকা-গুলো কেন ঘটেছে তা গবেষণা করে বের করা দরকার। সূর্য সেনের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন ॥ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী পরিদর্শন করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মভিটা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিশেষ নিরাপত্তায় রাউজানের নোয়াপাড়ায় যান। সেখানে তিনি মাস্টারদার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরিদর্শন করেন মাস্টারদার নামে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি স্থাপনা। এরমধ্যে রয়েছে তাঁর আবক্ষ ভাস্কর্য, সূর্যসেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মহাকবি নবীন সেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। মন্তব্য বইতে নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করেন প্রণব মুখার্জী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই বীর যোদ্ধার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাউজান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, সূর্যসেন স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নগরীর চাবি প্রদান ॥ রাউজানে মাস্টারদা’র বাড়ি পরিদর্শন শেষে তিনি ফিরে আসেন নগরীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে। সেখানে তিনি ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন আয়োজিত একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। একই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রণব মুখার্জীকে নগরীর স্মারক চাবি উপহার দেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির জানান, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন টানানোসহ বড় ধরনের প্রস্তুতি ছিল কর্পোরেশনের। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি মেলেনি। প্রণব মুখার্জীকে সম্মাননা জানাতে সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন প্যানেল মেয়র হাসান মাহমুদ হাসনি, জোবাইরা নার্গিস খান, নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শামসুদ্দোহা, সচিব মোঃ আবুল হোসেন, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিয়া শিরিন, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আক্তার চৌধুরী ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোঃ সাইফুদ্দিন। এর আগে বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করলে প্রণব মুখার্জীকে স্বাগত জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান ও জেলা প্রশাসক জিল্লুর রহমান চৌধুরী, সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইসি এসএম মনিরুজ্জামানসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা। এদিকে, প্রণব মুখার্জীর আগমনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন। হোটেল রেডিসন ব্লুসহ যে সব স্থানে তাঁর যাওয়ার কথা রয়েছে তার প্রতিটি স্পটে গড়ে তোলা হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র‌্যাব, আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এছাড়া এসএসএফের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাতো ছিলই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৩ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে জেলা পুলিশ এবং সিএমপির পক্ষ থেকে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী মঙ্গলবার রাতে হোটেল রেডিসনে অবস্থানের পর আজ বুধবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন। তবে যাওয়ার আগে তাঁর পাহাড়তলীতে বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতি বিজড়িত ইউরোপিয়ান ক্লাব এবং নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার পরিদর্শনের কথা রয়েছে। এই অস্ত্রাগার থেকেই ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা অস্ত্র লুট করে নিয়েছিলেন।
×