ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে যাবে তিন শ’ ॥ দু’ দেশের মধ্যে ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি

দু’ বছরে প্রত্যাবাসন ॥ মিয়ানমার ফেরত নেবে রোহিঙ্গাদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

দু’ বছরে প্রত্যাবাসন ॥ মিয়ানমার ফেরত নেবে রোহিঙ্গাদের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের আগামী দুই বছরের মধ্যে ফেরত নেবে মিয়ানমার। প্রতিদিন ৩০০ রোহিঙ্গা নাগরিককে ফেরত নেবে দেশটি। মঙ্গলবার নেপিডোয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তিতে (মাঠ পর্যায়ের বাস্তব ব্যবস্থা) এসব বলা হয়েছে। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে এ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। এর আগে সোমবার সারাদিন যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়। মঙ্গলবার মিয়ানমারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে আর বাংলাদেশে আসতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমার সম্মত হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশে ট্রানজিট ক্যাম্প হবে পাঁচটি এবং মিয়ানমারে অভ্যর্থনা ক্যাম্প হবে দুটি। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের লা পো থং নামক একটি জায়গায় অস্থায়ীভাবে রাখা হবে। তারপর বাড়িঘর সংস্কার করে তাদের সেখানে পাঠানো হবে। এতে আরও বলা হয়, সহিংসতায় যেসব শিশু অনাথ হয়েছে এবং বাংলাদেশে যাদের জন্ম হয়েছে তাদেরও এই এ্যারেঞ্জমেন্টের আওতায় ফেরত পাঠানো হবে। এজন্য দুটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। একটি রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এবং অন্যটি প্রত্যাবাসনের জন্য। দুই দেশের মধ্যে মঙ্গলবার সই হওয়া চুক্তির বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা একটি ভাল চুক্তি করেছি, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। আমরা বলেছি যখন থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার দুই বছরের মধ্যে প্রেফারেবলি শেষ হবে। এটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং মিয়ানমার এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রস্তাব করেছিলাম প্রতি সপ্তাহে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাব। কিন্তু তারা ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারা নিজেরা রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করেছে। ফলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিদিন ৩০০ করে রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পর্যালোচনা করে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে। রাষ্ট্রদূত জানান, এই ব্যবস্থার অধীনে একটি পরিবারকে একটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হবে অর্থাৎ একটি ফরমে পুরো পরিবারের তথ্য থাকবে এবং মিয়ানমার এটি গ্রহণ করবে। ফলে প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। এছাড়া জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে বাংলাদেশ কাজে লাগাবে এবং মিয়ানমার তাদের সময়মতো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। নেপিডোতে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। আর মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সোমবার দিনভর আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষ কোন সমাধানে আসতে পারেনি। তবে মঙ্গলবার সকালে আবারও উভয়পক্ষের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল ফিজিক্যাল এ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি সই করে। নেপিডোর বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল যোগ দেয়। এই প্রতিনিধি দলে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর ছিদ্দীক, কক্সবাজারের ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (শরণার্থী) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মনিরুল ইসলাম আখন্দ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী প্রমুখ রয়েছেন। এছাড়া মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমানও যোগ দেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ দুই দেশের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে সব ধরনের উদ্যোগ নেবে। গত ২৩ নবেম্বর নেপিডোয় উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আলোকে এই ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ঢাকায় এক বৈঠকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এই যৌথ গ্রুপ রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন শুরু করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেবে। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে ১৫ জন করে সদস্য নিয়ে মোট ৩০ সদস্যের এই গ্রুপ গঠন করা হয়। রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। সেনাবাহিনী অভিযান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত ২৩ নবেম্বর নেপিডোয় দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আগামী ২৩ জানুয়ারির মধ্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ।
×