ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ॥ ৯ এনজিওকে তলব

এনজিও’র রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

এনজিও’র রমরমা বাণিজ্য

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত ১২টি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে কিছু সংখ্যক এনজিওর রমরমা বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দিনের বেলায় রোহিঙ্গাদের নামে ত্রাণ বিলি-বণ্টন করার পর এসব এনজিও’র নিয়োজিত ঠিকাদার সন্ধ্যার পর ওই ত্রাণ স্বল্পমূল্যে কিনে নিচ্ছে। পরবর্তীতে একই ত্রাণ ফের সরবরাহ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বস্তা ভর্তি একটি পণ্য অন্তত ২-৩ বার সরবরাহ দেখানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু বদলানো হয়ে থাকে বস্তা বা প্যাকেট। এ ধরনের এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম করার প্রমাণ পেয়ে ৯টি এনজিওকে তলব করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আসা অর্থ যাচ্ছে কিছু এনজিওর পকেটে। আর রোহিঙ্গারা পাচ্ছে ওই পণ্যের বাজারমূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে নগদ টাকা। এ ধরনের দুর্নীতিবাজ নয়টি এনজিওর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন। এছাড়া এসব এনজিওর বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূত কার্যক্রম চালুর সত্যতাও পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। তাই এসব এনজিওকে বাণিজ্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। ১০ জানুয়ারি ইস্যু করা ওই চিঠিতে সাত কর্মদিবসের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে। কাল বৃহস্পতিবার এনজিও ব্যুরোর বেঁধে দেয়া সাত কর্মদিবস শেষ হচ্ছে। তাই দুর্নীতি আড়াল করতে ওইসব এনজিওর প্রতিনিধিদের কেউ কেউ ব্যাপক তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য দেয়া ত্রাণ বিতরণে এসব এনজিও রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও খোলাবাজার থেকে কম দামে পণ্য কিনে প্যাকেটে ভরে বেশি খরচ দেখিয়ে ফের সরবরাহ দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে সস্তা দামে পণ্য কিনে এনে দুর্নীতি পরায়ন এনজিওগুলোকে সরবরাহ দিতে তারা প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে বহুলোক নিয়োজিত রেখেছে বলে জানা গেছে। এদিকে এসব বিষয় আঁচ করতে পেরে জেলা প্রশাসক আলী হোসেন ৪ জানুয়ারি ওই নয়টি এনজিওর নানা অনিয়ম সংবলিত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের কাছেও প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন তিনি। ৯টি এনজিওর অনিয়মের প্রসঙ্গ তুলে জেলা প্রশাসক বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য ৯০টি এনজিও জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু এনজিওর কার্যাবলিতে অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা অনাকাঙ্খিত। একই সঙ্গে এসব এনজিওর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও অনুরোধ জানান তিনি। নয়টি এনজিও হচ্ছে- অগ্রযাত্রা বাংলাদেশ, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন, সোশ্যাল এ্যাজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার এ্যান্ড এ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ছওয়াব), কাতার চ্যারিটি, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, নেটওয়ার্ক ফর ইউনিভার্সেল সার্ভিসেস এ্যান্ড রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট (নুসরা), সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল ও ইউনাইটেড সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট (ঊষা)। অপরদিকে নগদ টাকার লোভে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ত্রাণ হিসেবে পাওয়া খাদ্য সামগ্রী (তেল, ডাল, কম্বল, জ্বালানি) বিক্রি করে দিচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া ত্রাণ সামগ্রী বাজার মূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিচ্ছে অধিকাংশ রোহিঙ্গা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কম দামে এসব ত্রাণসামগ্রী কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে দোকানে, খোলাবাজারে, এনজিও এবং কতিপয় দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের কাছে। এনজিও, ঠিকাদার ও দোকানিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের চাহিদা মতো কিনে নিচ্ছে এসব ত্রাণ। সূত্র জানায়, ত্রাণ কিনতে ১২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক অন্তত ২৫টি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ক্যাম্পগুলোতে ত্রাণ কিনতে সিন্ডিকেট সদস্যদের হুড়োহুড়ি করতেও দেখা গেছে। এসব ত্রাণ কিনে নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রথমে স্থানীয় বিভিন্ন দোকান ও বাসা-বাড়িতে মজুদ করে। পরে তাদের সুবিধা অনুযায়ী এনজিও বা ঠিকাদারদের কাছে সরবরাহ করে থাকে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব সিন্ডিকেট সদস্যরা মালামালগুলো একত্রে ক্যাম্প থেকে বের না করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বিভিন্নভাবে নানা স্থানে মজুদ করে রাখে। নয়াপাড়া, মুচনি, লেদা, পুঠিবনিয়া, জামতলী, থাইংখালী, কুতুপালং, বালুখালী, পালংখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা এক কেজি চাল বিক্রি করছে মাত্র ৩০ টাকায়। চিনি বিক্রি করছে ২৫ টাকা। ডাল বিক্রি করছে কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকায়। ১ লিটারের সয়াবিন তেল মাত্র ৬০ টাকা, লাক্স সাবান মাত্র ১০ টাকা ও ৫শ’ গ্রাম পাউডার দুধ বিক্রি করছে ১শ’ টাকায়। হত্যা-নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ঠকিয়ে রমরমা বাণিজ্য করছে দেশী-বিদেশী এসব এনজিও। সূত্র আরও জানায়, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ত্রাণ হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে তুঁষের লাকড়ি।
×