ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে গত বছর ১৫ শ্রমিকের মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

চট্টগ্রামে জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে গত বছর ১৫ শ্রমিকের মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চট্টগ্রামের সীতাকু--কুমিরায় অবস্থিত জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে ১৫ শ্রমিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ২২ জন। এক বছরে শ্রমিক হতাহতের তথ্য সংগ্রহ করে এ সংখ্যা জানিয়েছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেইফটি, হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি)। ওশি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত বার্ষিক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ওশির নিজস্ব তথ্য সংগ্রহকারী এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে- জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার পাতের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকা-, এক্সকাভোটরের আঘাত এবং বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া। ওশির নির্বাহী পরিচালক আমিনুর রশিদ চৌধুরী রিপন বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজভাঙ্গা শিল্প এলাকা চট্টগ্রামে। এখানে প্রায় ১০০টি ইয়ার্ডে কাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক। এছাড়া পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে আরও ১০ হাজার জন। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হচ্ছে এসব শ্রমিকদের। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের সকল দেশে ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজভাঙ্গা নিষিদ্ধ থাকলেও বাংলাদেশে এটা চালু রয়েছে। যা শ্রমিকদের জীবনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া ইয়ার্ডগুলোতে ক্ষতিকর এ্যাসবেসটসের কারণে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়ছেন শ্রমিকরা। কিন্তু বাংলাদেশ শ্রম বিধি অনুযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তাসহ কোনও বিষয়ই পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে না। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৯৩ শ্রমিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১৫৪ জন। ২০১৩ সালে নিহত ২৬ ও আহত ৪০, ২০১৪ সালে নিহত ১৫ ও আহত ৩৪, ২০১৫ সালে নিহত ১৪ ও আহত ২৭, ২০১৬ সালে নিহত ২৩ ও আহত হন ৩১ জন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশকিছু ইয়ার্ডে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ইয়ার্ডে হতাহতের সংখ্যাও বেশি। ফেরদৌস স্টিল-এ তিনটি দুর্ঘটনায় ১ শ্রমিক নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছেন, কে আর স্টিল-এ তিনটি দুর্ঘটনায় ১ শ্রমিক নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছেন, এস এন কর্পোরেশন-এ চারটি দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত এবং ২ জন আহত হয়েছেন এবং লালবাগ শিপইয়ার্ডে একটি দুর্ঘটনায় ৪ জন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯৫ শতাংশ ইয়ার্ডের মালিক তাদের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ- হেলমেট, সেফটি জ্যাকেট, বুট ইত্যাদি সরবরাহ করেন না। অন্যদিকে যেসব ইয়ার্ডে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয় সেখানকার শ্রমিকরাও এসব ব্যবহারে উদাসীন থাকেন। দেখা গেছে, যেসব শ্রমিক পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং নিরাপত্তা নির্দেশিকা মেনে চলছেন তারা দুর্ঘটনা থেকে মুক্ত। সমীক্ষা অনুযায়ী, হতাহতদের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা এবং তরুণ শ্রমিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের অধিকাংশই ইয়ার্ডগুলোতে জাহাজ কাটার কাজ করতেন। ওশির প্রতিবেদনে জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে শ্রমিকদের হতাহতের পেছনে রাতের বেলায় কাজ করা, সেইফটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমিক নিযুক্ত করা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ প্রদানে মালিকপক্ষের অনীহা, শ্রম আইন ও বিধিমালার অপর্যাপ্ত প্রয়োগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অপর্যাপ্ত পরিদর্শন ব্যবস্থা এবং ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা হয়। জাহাজভাঙ্গা শিল্প এলাকায় কর্মপরিবেশ এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে ওশির পক্ষ থেকে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। শ্রম বিধি ২০১৫ অনুযায়ী প্রতিটি ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন ও তা কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছে ওশি ফাউন্ডেশন। তাছাড়া রাতের বেলায় কাজ করা, নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ ছাড়া কোন শ্রমিক নিযুক্ত করা এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ পরিধান না করলে জাহাজকাটার কাজে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সুপারিশ করা হয়। জাহাজভাঙ্গা ইয়ার্ডে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন আর কোন শ্রমিক দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হন সেজন্য ওশির পক্ষ থেকে হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, মালিকপক্ষের উদ্যোগে শ্রমিকদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার পাশাপাশি পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেয়া, সরকারের উদ্যোগে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর থেকে ইয়ার্ডগুলোতে স্থায়ী পরিদর্শক নিযুক্ত করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহের দাবি জানানো হয়।
×