ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

‘যাহা ৫২ তাহাই ৫৩’

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

‘যাহা ৫২ তাহাই ৫৩’

ফজামিঞার মাথা গরম, কারণ কাল রাতে সে মোটেও ঘুমোতে পারেনি। ‘থার্টিফার্স্ট ইভ’ নামে কি জানি একটা বলে, তার গুঁতোয় ফজামিঞার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। আসলে কী হয়েছে জানেন তো- রাত বারোটার পর এলাকার উঠতি ছেলে-মেয়েগুলো এককাট্টা হয়ে বাড়ির ছাদে উঠেছে। ওরা মাঠে নামতে পারেনি, কারণ ডিএমপি এবার আগের চেয়ে আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপ করেছে। যাকে বলে খড়গহস্ত। সাফ বলে দিয়েছে, এই বিশেষ রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নো নাচাগানা, নো হৈ-হাঙ্গামা। একটাই গীত ফজামিঞা রাতভর শুনতে পেল- তা হল, নাগিন! নাগিন! নতুন বছরকে বরণ করবে ভাল কথা, কিন্তু তাতে হঠাৎ সাপের গুণকেত্তন করার কী হলো, তাই সে বুঝে উঠতে পারে না। তাও আবার মায়ের ভাষা ছেড়ে হিন্দীতে! কেন ভাই? এটা কি হিন্দী নিউ ইয়ার নাকি! ফজামিঞা ছাপোষা মানুষ। সে একটা প্রিন্টিং প্রেসের ফোরম্যান, মানে মেশিনপত্র দেখাশোনা করে। বয়স হয়েছে, বউ-পোলাপান আছে। মাস গেলে খাই-খরচাবাবদ মেলা টাকা গুনতে হয়। জিনিসপত্রের দাম চড়চড়িয়ে বাড়লেও তার বেতন বাড়ার নামটি নেই। রাতে ভাল ঘুম না হলে কী হবে, রাত পোহাতেই তাকে অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। বাসা থেকে অফিস মেলা দূর। চাইলেও কাছে-কিনারে বাসা পাওয়া যায় না। যাও বা পেয়েছিল, ভাড়া অনেক। বাড়িওয়ালা কথায় কথায় নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়ায়। ফজামিঞার মতোন মামুলি লোকের পক্ষে চাহিদামাফিক কর্মস্থলের ধারে-কাছে বাসা নেয়া কঠিন বৈকি। তো যা বলছিলাম- নতুন বছর আসছে এই নিয়ে ফজারমিঞার মনে মোটেও আনন্দের ফরফরানি নেই। সে বরং ভাবছে, আসছে বছর চালের দাম কত বাড়বে! জ্যামের গুঁতোয় শহরে টেকা যাবে তো! কাল মোটা চাল ছিল তিপ্পান্ন টাকা কেজি, ২০১৮তে তা বেড়ে ষাট হবে নিশ্চয়ই। সামনে নির্বাচন, সরকার চাইবে সবকিছু ঠিকঠাক চলুক, কিন্তু বিরোধী শিবিরে এখন আনন্দ নাকি শোকের মাতম, ঠিক বোঝা যায় না। তারা চাইবে সরকারকে ‘টপল ডাউন’ মানে ঠেলে ফেলে দিতে। এ জন্য তারা না জানি কত রকম ফন্দিফিকির করছে এবং করবে! ফজারমিঞার বউ বিলিতি বেগম সমানে গলা বাজায়। তার এক কথা- পুরনো বছর যা করেছ মেনে নিয়েছি, এবার কিন্তু ভাল-মন্দ কিছু কিনে দিতে হবে। মানে নেকলেস। এবার ফজামিঞার মাথায় চক্কর দেয়। সে শোনে, বউ বলছে নেকলেস মানে সাপের লেজ! অনেকে আবার এই সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকোতে বিলক্ষণ ওস্তাদ। ফজামিঞা কিন্তু সাপ দেখে ভয় পায়, কারণ ওরা লেজ দিয়ে হাঁটে। সাপের বুকপিঠ নেই। ওরা যখন তখন দংশন করে, বিষ ঢালে। কি জানি, নতুন বছর কে কীভাবে বিষ ঢালবে আমাদের জাতীয় জীবনে! রোহিঙ্গারা তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসে মহা মুসিবতে ফেলেছে আমাদের। ফজামিঞার তাই নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ওরা নাকি ক্রমশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পড়বেই তো! খেয়ে-বসে কাজকাম নেই, দিনভর নানা কোম্পানির রিলিফ নেয় আর অলস মস্তিষ্কে কুবুদ্ধি ভাজে। ফজামিঞা নিশ্চিত নয় যে, নতুন বছর আগের চেয়ে ভাল কাটবে। বরং জ্ঞানীজনে বলে যে, ‘দিন যায় ভাল, আসে খারাপ’। আদতে সে কাল রাত আর আজকের সকালের মাঝে কোন তফাত খুঁজে পায় না। ঘুম ভাঙতেই বাচ্চার ঘ্যান ঘ্যান, তারে কিছু কিনে দিতে হবে। কারণ, হ্যাপি নিউ ইয়ার। খেঁকুরে গলায় ফজা বলল, তাতে কি! ছোটলোকের আবার নিউ ইয়ার! ওসব বড়লোকের বিলাসিতা, যাদের টাকা ফেলার জায়গা নেই। একটু তলিয়ে ভাবুন তাহলেই বুঝবেন, নতুন বছর মানে আসলে কিছুই নতুন না। বিশেষ করে যে সকল জিনিস আপনি মনেপ্রাণে চান, কিন্তু তা একই থাকবে। এই যেমন ধরুন বদমেজাজি বস, খরুচে বউ, চালিয়াত শ্যালিকা, পদোন্নতিবিহীন চাকরি, সিঙ্গেল ডিজিট মাইনে- এমন কি আপনার পোড়া কপালটাও কি বদলাবে ভেবেছেন! মোটেও না। তার মানে যাহা বায়ান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন! ফজামিঞা নাকেমুখে দুটো গুঁজে বেরিয়ে পড়ে অফিস যাবে বলে। সে না গেলে মেশিন চলবে না, মানে প্রোডাকশন বন্ধ। কাজ বন্ধ থাকলে মালিকের মুখ ভার। কারণ তাকেও তো কিছু করে খেতে হয়। কামাই না হলে কর্মচারীদের বেতন কিভাবে হবে! তার মানে গিয়ে দাঁড়ালো, খেটেখাওয়া চুনোপুঁটি মানুষের নতুন বছরে কোনো খোশখবর কিংবা আব্দার-আহ্লাদ নেই। কাজের ভিড়ে তাদের সেই ঠুনকো আবেগটুকু কখন হারিয়ে যায়! অথচ খবরে প্রকাশ, থার্টিফার্স্ট নাইটের একরাতে নাকি ঢাকা শহরে শুধু আলোকসজ্জা বাবদ খরচ হয় কয়েক শ’ কোটি টাকা। ফজামিঞা অবশ্য কোটি-ফোটি বোঝে না, দশ হাজার টাকা হাতে এলেই বুকটা কেমন ধড়ফড় করে। যদিও মাসের মধ্যিখানে এলেই হাত ফাঁকা হয় তার। চাল-ডাল-নুন কেনার মতো পয়সা থাকে না। বউ খালি খিটিমিটি করে, কথা শোনায়। স্বামীর অযোগ্যতা নিয়ে উপহাস করে। কিন্তু তাকে কে বোঝাবে যে, দুনিয়াটা কারও মামার বাড়ি বা শ^শুরবাড়ি নয়। ফজামিঞার মতো মানুষ বেঁচেবর্তে আছে এই ঢের। নতুন বছরে সরকার না জানি কী কী সব দরকারি কাজে ব্যস্ত থাকবে, আম-পাবলিকের মৌলিক-মানবিক অধিকার সুরক্ষার দিকে তাকানোর তার ফুরসত কই! সাধারণ মানুষ গিফেনদ্রব্য যোগাড় করতে পারল কি না, ছেলেপুলের স্কুলের বেতন যোগাড় হলো কি না, তাদের পরনে পাতলুন আর পেটে দুটো খুদকুঁড়ো কিছু জুটল কি না, এসব দেখার দায় বা দরকার তাদের নেই। ফজামিঞা ঠিক ভরসা পায় না। রাস্তায় নেমেই দেখে গিজগিজে জ্যাম। গাড়ি নড়ে না, একেবারে মাখামাখি ভিড় যাকে বলে। কাহিনী কী! চোখ-কান খোলা রেখে সামনে এগিয়ে যায় ফজামিঞা। শুনতে পায়- কারা যেন আমরণ অনশন করছেন। কারা আবার! মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকগণ রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। কারণ, তাদের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। তারা এমপিওহীন, মাগনায় মানুষ তৈরি করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। অথচ তার নিজের ছেলের স্কুলের বেতন দেয়ার মতোন সঙ্গতি নেই। ফজামিঞা ভাবতে পারেন না, এটা কী করে হলো! একটি স্বাধীন দেশে একজন শিক্ষক গ্রাসাচ্ছদের জন্য রাস্তায় নেমে পড়েছেন! এদের অবস্থা তো তার চেয়েও খারাপ। কালঘাম ছুটিয়ে ফজামিঞা তাও কিছু করে খাচ্ছে। নাহ, এ ভয়ানক অন্যায়। শিক্ষকদের এমন অবমাননা মেনে নেয়া যায় না। কখনও না। মনে মনে বলে ফজামিঞা। এটা নাকি নির্বাচনী বছর। ভাবতেই বুকের ভেতর শিহরণ জাগে ফজামিঞার। তার মানে দিনবদল হবে, সরকার বদল অবশ্য তত জরুরী নয়। বিরোধীদের ভাবসাব দেখে মনেই হয় না তারা ইলেকশনে শামিল হবে! বড্ড গা-ছাড়া ভাব। তার মানে এই বছর বেশ ডামাডোলের মধ্য দিয়ে যাবে। কিন্তু তাতে ফজামিঞার কী! সে তো একজন মামুলি ভোটার। ভোট নিয়ে বা না নিয়ে হোক, সিল একটা মারতে হবে ব্যস। একবার ভাবল, আজ অফিস না গেলে হয় না! কথায় বলে, শুরুর দিন যেমন যায়, পরেও তার রেশ রয়। এই কারণে অনেকে কষ্ট করে হলেও বছরের পয়লা দিন ভাল-মন্দ কিছু রেঁধে খায়। ভুলেও পরের বাড়ি যায় না। পুরো বছরটাই তাহলে হয়ত উষ্ণবৃত্তি করে কাটাতে হবে। ফজামিঞা এও বোঝে, সব কথার কথা। না, সে অফিসেই যাবে। কারণ যার কাজ নেই, মানে বেকার, সেই কেবল বোঝে কাজ করতে না পারার কী বেদনা। এমপিওহীন শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করে অফিসে ছোটে ফজামিঞা। সরকার যদি সদয় হয়ে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়, তাহলেই কেবল নতুন বছর ভাল। নইলে তো সেই একই কাহিনী- যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×