ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চের ভাষণ ॥ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এবং আগামীর ভাবনা

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

৭ মার্চের ভাষণ ॥ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এবং আগামীর ভাবনা

৭ মার্চ ১৯৭১। বাঙালীর জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় দিন। এদিন বাঙালী জাতিসত্তার ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার উপস্থিতিতে ৭ কোটি মানুষের মুক্তির দিক-নির্দেশনা সংবলিত ভাষণ প্রদান করেন। মাত্র ১৮ মিনিটের এ অনবদ্য জগদ্বিখ্যাত ভাষণে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙালীদের দ্বন্দ্বের স্বরূপ এবং কিভাবে বাঙালীরা পাকিস্তানী শাসকদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে, সে প্রেক্ষাপটে মুক্তির দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি জানতেন তাঁর এ সংক্ষিপ্ত ভাষণ মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের দিক-নির্দেশনা গ্রোথিত আছে। যা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভাল দৃষ্টিতে নেবে না। এ ভাষণের পর নিরীহ বাঙালীদের পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণ আসতে পারে। সেই বিচক্ষণতা থেকেই তিনি ঘোষণা করেন : ‘... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী এই ভাষণ সমগ্র বাঙালী জাতিকে শুধু উজ্জীবিত করেনি। বরং নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন,... আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। ... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’ একজন রাজনৈতিক কবি কিভাবে মুক্তিকামী মানুষকে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সমান্তরালভাবে জাগিয়ে তুলতে পারে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তার উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। এই প্রেরণাদীপ্ত ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালী মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লাখ শহীদ, ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭৫ সালে পাকহানাদার বাহিনীর সহচর ঘাতকগণ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশকে মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী ধারায় নিয়ে যায়। তারা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি সঠিক ইতিহাসকে প্রজন্মের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। ঐতিহাসিক ও কালজয়ী যে ভাষণ এখনও প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তির প্রবল আকাক্সক্ষা থেকে শিহরিত করে, ঘাতকের দল সেই ভাষণ প্রচার স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের অন্তর থেকে সেই মহাকাব্যিক শব্দ চয়ন, যা বঙ্গবন্ধুর তেজদীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, তা থেকে মানুষের প্রাণবন্ধন বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। ’৭৫-এর পরবর্তী যে ভাষণ ইতিহাসের খলনায়কদের প্রতিনিয়ত ভয় ও আতঙ্কের কারণ ছিল, সেই ভাষণ আজ দেশের গ-ি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ইউনেস্কোতে স্থান পেয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ইউনেস্কো ভাষণটিকে মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা বিশ্বের স্মৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। স্বীকৃতির যৌক্তিকতা তুলে ধরে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা বলেছিলেন ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ কর্মসূচী পরিচালিত হওয়া উচিত দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম সংলাপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা তাদের মনে লালন করতে পারে।’ একই প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয় ঢাকায় নিযুক্ত ইউনেস্কোর কান্ট্রি ডিরেক্টর বিট্টিচ কালদুলের কণ্ঠে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হিসেবে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে যুক্ত করতে পেরে ইউনেস্কোও গর্বিত।’ ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ঐতিহাসিক নথি ও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একটি ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতিকে একত্রিত করার ইতিহাসের দলিল এটি। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ভাষণটির ওপর অনেক পর্যালোচনা করে দেখা যায় এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।’ তাদের এ মূল্যায়নে আমরা গর্বিত, আনন্দিত, অনুপ্রাণিত। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের ১৮ মিনিটের এই অসাধারণ কাব্য বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন বাংলাদেশকে অধিকতর মর্যাদাবান করেছে। অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের স্বীকৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে প্রেরণা দেবে। এই ভাষণের স্বীকৃতি অর্জন আমাদের অহংবোধ যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি এই অসাধারণ অর্জনকে ধরে রাখার জন্য আত্মত্যাগের পরীক্ষা সামনে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর এ অনবদ্য ভাষণটি জাতীয় মুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা ছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে দেশমাতৃকা মুক্তির দিক-নির্দেশনা যেমন এ ভাষণে ছিল, তেমনি ছিল শোষণ-বঞ্চনা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে পরিপূর্ণ রূপকল্প। যেটি মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা স্বহস্তে নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঘাতকের দল জাতিকে এর সুফল পেতে সুযোগ দেয়নি। তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি পরতে পরতে ঘাতকচক্র পরাজিত শক্তির ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে। ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে শোষণ, নিষ্পেষণ, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ও নাগরিক মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করে মানুষকে দারিদ্র্যসীমার মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার কৌশল ছিল এ কুচক্রীমহলের রাজনীতির চর্চার হাতিয়ার। একটি প্রজন্মকে এ কৌশলের মাধ্যমে তারা বিভ্রান্ত করেছে। ভুল ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে জাতিকে একত্রিত করার চেয়ে বিভক্তির পথে উস্কে দিয়েছে। সেই বিপরীতমুখী স্রোতের প্রতিকূল প্রবাহে বাংলাদেশকে আগামী প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই এখনও আমাদের শেষ ভরসা। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রদত্ত কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণ এখনও স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। এই নির্দেশনার ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি, মানবতার জননী, বাংলার নবজাগরণের কবি শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে ইতোমধ্যে অনেক অসাধারণ অর্জন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, এশিয়ায় সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের আবির্ভাব, নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মডেল বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ঈর্ষণীয় সাফল্য, মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা পৌঁছে দেয়া, নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্পের ৯৫ ভাগ বাস্তবায়ন, বিদ্যুত সমস্যার সমাধান ও ৭৫ ভাগ মানুষকে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় আনা, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বেকারত্বের হার হ্রাস বিশ্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের রাজনীতিতে বিচরণ কঠিন থেকে কঠিনতর করা হয়েছে। এই অসামান্য অর্জনকে ধরে রাখতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিজন সৈনিককে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের পাশে দাঁড়াতে হবে। উন্নয়নের যে সুফল জাতিগতভাবে আমরা পাচ্ছি, তার সুফল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। মানুষকে দাবিয়ে রেখে শাসকগোষ্ঠীর ছদ্মছায়ায় মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র যেন স্বপ্নের বাংলাদেশ পরিণত না হয়, সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০২১ সালে মধ্যম ও ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রিয় মাতৃভূমি এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, বিভক্তি-বিভাজন দূরীকরণ, উন্নয়নের সমবণ্টন, বেকারত্ব হ্রাস, মানুষের মৌলিক অধিকারের সুনিশ্চিত নিরাপত্তা বলয় তৈরি অগ্রগতির অগ্রগমনের পথে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির প্রতিজনকে আত্মকেন্দ্রিকতার উর্ধে উঠতে হবে। তাই আমাদের অঙ্গীকার হোক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে জীবন চালিকার প্রতিটি পরতে স্থান করে দেয়ার। কর্ম ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমের মাধ্যমে পরাজিত শক্তির সকল অপতৎপরতা নস্যাৎ করে দেয়ার। কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়ার পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও মানবতার জননী শেখ হাসিনার ত্যাগের রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করার। তাহলেই এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশকে কেউ থামিয়ে দিতে পারবে না। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)
×