ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

রিপোর্টারের ডায়েরি

লালাখাল কত দূর? ২৩ ডিসেম্বর, শনিবার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি লালাখাল পরিদর্শন করতে দুপুর ১২টার মধ্যে আমরা শতাধিক বন্ধু গাড়িতে করে সিলেট শহর থেকে রওনা দেই। আমাদের সঙ্গে পর্যটন কোচে থাকা বন্ধু ফেরদৌস জানায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় স্বচ্ছ নীল পানির লালাখাল পৌঁছতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। সিলেট-তামাবিল সড়কে গাড়ি এগিয়ে যায়। দেড় ঘণ্টা গাড়ি চলার পর সবাই তার কাছে জানতে চায় কি বন্ধু লালাখাল আর কত দূর? এক পর্যায়ে রাস্তায় চা বিরতির পর আবারও গাড়ি সামনে এগিয়ে চলে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর সেই কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে আমরা আনন্দে মেতে উঠি। জায়গাটার নামের সঙ্গে খাল শব্দ যুক্ত হলেও এটা মূলত সারি নদীর একটা অংশ। পানি স্থির নয়, সব সময় চলমান। এ পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আমরা ১০ জন করে একেকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ওঠে বসি। দেখি নদী আর পাহাড়ের এক অপরূপ মেলবন্ধন। নদীর নীল টলটলে পানি আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, এ যেন প্রকৃতির এক মায়াময়ী রূপের বাহানা। নদীতে চলমান নৌকার ওপর বসে পাহাড় দেখার সৌন্দর্যই আলাদা। নীল পানি, পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, চা-বাগান ও নানা জাতের পশু-পাখির দেখা পাই লালাখালজুড়ে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা যেন কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাই। এক পর্যায়ে নৌকা থেকে নেমে আমরা সবাই লালাখাল চা বাগান পরিদর্শন করি। চা বাগানে প্রবেশ করতেই বন্ধুদের মধ্যে হৈ চৈ আর ছবি তোলার ধুম পড়ে যায়। কখনও একক কখনও গ্রুপ ছবি এভাবেই চলতে থাকে। প্রকৃতিকে হাতের নাগালে পেয়ে ছবি তোলা যেন আর শেষ হয় না। সবাইকে ছবি তোলার কাজে সহযোগিতা করেছে ইউসুফ বাবু ও ফজলে ক্ষুদাসহ ক’জন বন্ধু। এ আনন্দ যাত্রায় সরব ছিল বন্ধু জহির, বাদল, ইকবাল, মাহবুব, ইভা, শিখা, খারেস, স্বপন মাহমুদ, মৃদুল, শ্যামল, রেজাউল করিম স্বপন, সাঈদ, পারভীন, নাজমা, মোস্তাফা, বাসন্তী, মজিবুর রহমান জাহাঙ্গীর, ফারুক, লাকী, মিতালী, সেলিম, দেলোয়ার, রঞ্জন, আজাদ, মোহসীন, জামসেদ, শাহজাহান, নিয়াজ, বশির, রঞ্জু, শরীফ, সাহীদ, রুবি, শিপন, মিজান, সাজু, শতদল, জেসী, শিল্পী, মিনু, বেলি, আঞ্জু, কচি, জাহাঙ্গীর, রউফ, নাসির, জীবন, রাজু, জাকির, লুৎফর, জসিম, অনিতা, ডলিসহ আরও অনেকে। লালাখালে নৌকা ভ্রমণে থাকতেই জানতে পারি ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে বেয়ে আসা নীল পানি গড়িয়ে চলেছে এখান দিয়ে। নদীতে ¯্রােত থাকায় যাওয়ার পথে সময় বেশি লাগলেও ফিরতি পথে পাওয়া যায় বাড়তি সুবিধা। এ আনন্দ ভ্রমণের সময় আমাদের নৌকায় ছিল সৈয়দ ছলিম ও চুনী চৌধুরী দম্পতি। ভ্রমণপ্রিয় আমাদের এ দুই বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় থাকতেই জোড়া বাঁধে। বন্ধুদের কেউ সিলেটে বেড়াতে গেলে খোজখবর নিতে ছুটে আসে ছলিম-চুনী জুটি। সম্প্রতি ‘বিচিত্র ভাবনা ও টুকরো স্মৃতি’ নামে সৈয়দ ছলিমের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বই জুড়ে ছলিমের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি, মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন, দাম্পত্য জীবন, বন্ধুত্বের অবগাহনসহ ভ্রমণ নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ আছে। এ ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথাও তুলে ধরেছে। স্ত্রী চুনী চৌধুরীকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর কথাও এ বইয়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১তম ব্যাচের বন্ধুদের সঙ্গে লালাখাল বেড়াতে গিয়ে ছলিম-চুনীকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। ঢাকায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে ছলিমের লেখা বই পড়ে খুবই ভাল লাগে। তাই আমাকে বইয়ের একটি কপি উপহার দেয়ার জন্য তাঁর প্রতি রইল অশেষ ধন্যবাদ। মিসরের নীল নদ দেখা সবার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। তবে লালাখাল দেখে মনে হতে পারে, এটা বাংলার নীল নদ। যাই হোক সেদিন আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যাবস্থা ছিল সিলেট ক্লাবে। কিন্তু লালাখাল ভ্রমণ শেষ আমরা সেখানে পৌঁছি বিকেল ৫টায়। আগে থেকেই আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিল সিলেট ক্লাবের সভাপতি একুশের বন্ধু শোয়েব চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর আমরা সবাই খাবার টেবিলে বসে পড়ি। এ সময় বন্ধু ফেরদৌস আলম, নীলুফার পারভীন চৌধুরী, হোসনে আরা খানম চিনু, পুলিন চন্দ্র রায়, নাসরাত আফসা চৌধুরী রুনী, ইমরান আহমেদ, ফয়জুন্নেছা মিলি, ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল, হাফিজ আহমেদ, কমলকলি চৌধুরী রকেট, ড. মোয়াজ্জেম, শংকর চৌধুরীসহ ক’জন বন্ধুর আন্তরিকতার কথা ভুলতে পারব না। শরীফুল ইসলাম অপ্রত্যাশিত প্রতিশোধ! স্মৃতির মণিকোঠায় দিনটা স্মরণীয়ই হয়ে থাকবে আমার জন্য। ৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২০১৬। স্থান-পল্টনের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়াম (উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়াম)। উদ্দেশ্য-ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া। রিপোর্টিং টাইম সকাল সাড়ে ১০টায়। বাসা থেকে বের হই সকাল সাড়ে ৯টায়। কিন্তু যাবার পথে শুরুতেই এক বিরক্তিকর যানজটে পড়ে যাই। এ যেন ‘বৃহস্পতিবারে শনির দশা’! শেষ পর্যন্ত সময় বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে প্রায় নব্বই শতাংশ পথই প্রাণপণে হেঁটে ভেন্যুতে গিয়ে পৌঁছি। ঘড়িতে তখন ১০টা ২০ মিনিট। তবে জোরে জোরে হাঁটার ফলে প্রচ- ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ফলে টিটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কমপক্ষে তৃতীয় স্থান অধিকারের আশাও একপ্রকার ছেড়ে দিই (২০১৪ আসরে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে তৃতীয় হয়েছিলাম। ২০১৫ সালে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি)। যাহোক, কিছুক্ষণ পরেই একে একে তশরিফ আনতে শুরু করলেন টিটির বাঘা বাঘা সব প্রতিযোগী। আর তাদের দেখে আমার মেরুদ- বেয়ে শীতল স্রোতের নিরবধি বয়ে চলা। হাল ছেড়ে দিই। হারিয়ে ফেলি সব আত্মবিশ^াস। উপস্থিত সব খেলোয়াড়কে নিয়ে গ্রুপিং ড্র করা হলো। চারটি গ্রুপ। এক গ্রুপে তিন জন করে। গত ২০১৪ আসরে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন, তাদের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে রাখা হলো। সেক্ষেত্রে আমার গ্রুপ হলো ‘সি’। আমার গ্রুপের অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গাজী টিভির সাজ্জাদ হোসেন এবং দৈনিক নয়া দিগন্তের জিলানী মিল্টন। যেহেতু খেলা আজকের মধ্যেই শেষ করতে হবে এবং আমাদের সবারই অফিসের কাজ বা এ্যাসাইনমেন্ট আছে, সেহেতু খেলা দ্রুত শেষ করতে সবার সম্মতিতে ডিআরইউ ক্রীড়া সম্পাদক কিছু নিয়ম প্রবর্তন করলেন। যেমন গ্রুপ পর্বে খেলার ফল নিষ্পত্তি হবে মাত্র এক সেটে, সেমিফাইনাল-ফাইনালে খেলার নিষ্পত্তি হবে দুই সেটে (১-১ সেটে ড্র হলে সেক্ষেত্রে খেলা গড়াবে তৃতীয় সেটে)। খেলা শুরু হতেই আরেক ঝামেলা শুরু হলো। বার বার ঘটতে লাগলো বিদ্যুত বিভ্রাট। অথচ খেলার ভেন্যুতে নেই কোন জেনারেটরের ব্যবস্থা। ফলে আমাদের বার বার বিদ্যুত ‘মহাশয়ের’ কাক্সিক্ষত আগমনের জন্য তীর্থের কাকের মতো অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় থাকতে হলো। শেষে আর না পেরে সবারই ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের সবাইকে নেয়া হলো পাশেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিতে। সেখানেই খেলা হবে। বিদ্যুত চলে গেলেও সমস্যা নেই, কারণ জেনারেটর ব্যবস্থা আছে। কোন ঝামেলা ছাড়াই দ্রুতগতিতে ক্রীড়ালেখক সমিতিতে খেলা চলতে লাগল। জানিয়ে রাখা ভাল, ক্রীড়ালেখক সমিতি আমার চেনা ভেন্যু, হোমগ্রাউন্ড বলতে পারেন। কেননা আমি এই সংগঠনেরই সদস্য (২০১১ সাল থেকে, ডিআরইউর সদস্য হই ২০১২ সাল থেকে)। চেনা ভেন্যুতে খেলার কারণেই হোক, আর অন্য কোন কারণেই হোকÑ ততক্ষণে আমার সব ক্লান্তি উধাও, হয়ে উঠেছি বেশ চাঙা! ফলে আমার শুরুটা মন্দ হলো না। প্রথম গ্রুপ ম্যাচে গাজী টিভির সাজ্জাদ হোসেনকে হেসে-খেলেই হারালাম, ২১-২ পয়েন্টে। দ্বিতীয় গ্রুপ ম্যাচেও তাই। এবার ২১-৫ পয়েন্টে পরাভূত করলাম নয়া দিগন্তের জিলানী মিল্টনকে। অপরাজিত গ্রুপসেরা হয়ে উন্নীত হলাম সেমিফাইনালে। শেষ চারের দ্বৈরথে প্রতিপক্ষ হিসেবে যাকে পেলাম, তাকে একদমই আশা করিনি। চ্যানেল ২৪-এর মুকিমুল আহসান হিমেল। গত তিন আসরের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন। গত ২০১৪ আসরে তার কাছেই সেমিফাইনালে হেরে গিয়েছিলাম (দুই সেটেই লিড নিয়েও শেষ পর্যন্ত ডিউজ করে হেরে যাই!)। দুরু দুরু বক্ষে ও এক গ্লাস শীতল জল পান করে আল্লাহ্র নাম নিয়ে খেলা শুরু করলাম। কি তাজ্জব ব্যাপার, হিমেলকে দাঁড়াতেই দিলাম না। বরং হারালাম শোচনীয়ভাবে, ২১-৫, ২১-১১ পয়েন্টে! গত আসরে সেমির সেই হারের প্রতিশোধটা তাহলে নিয়েই ফেললাম কড়ায়-গ-ায়, এবারের সেমিতে তাকে হারিয়ে। আরও মজার ব্যাপারÑ২০১৪ আসরে আমি হয়েছিলাম তৃতীয়, হিমেল হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন। আর এবার হয়েছে ঠিক তার উল্টোটিÑহিমেল হন তৃতীয় (দৈনিক সংগ্রামের জাফর ইকবালকে হারিয়ে, জাফর ছিলেন গত দুই আসরের রানারআপ), আর আমি হই চ্যাম্পিয়ন। তা, এবার হিমেলকে সেমিতে হারিয়েই উপলব্ধি হলো- ওহ্ মাই গড, তার মানে আমি ফাইনালে এবং কমপক্ষে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করছি, অর্থাৎ আমার রানারআপ হওয়া কেউ আটকাতে পারছে না! চ্যাম্পিয়ন যে হতে পারি, ঘুণাক্ষরে সেই চিন্তা ঠাঁই দেইনি মনে। তারপর কি হলো, সেটা বলব আরেকদিন। -রুমেল খান
×