ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তির বারতায় আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন সমাপ্ত

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

শান্তির বারতায় আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন সমাপ্ত

মনোয়ার হোসেন ॥ সাহিত্য বিকশিত করে মানুষের শুভবোধ, উচ্চকিত করে মানবিকতার বোধ। ছড়িয়ে দেয় শান্তির সুবাতাস। আর শান্তির সেই বারতা দিয়ে শেষ হলো আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন। সোমবার সম্মেলন শেষে ঢাকা ঘোষণায় সংঘর্ষময় পৃথিবী হটিয়ে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার কথা বলা হলো। সমাপনী দিনেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ভাষা ও সাহিত্যনির্ভর তিনটি অধিবেশন। প্রাণবন্ত সেসব আলোচনা কড়া নেড়েছে সাহিত্য অনুরাগী ও শ্রোতাদের মনে। সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে আলোড়িত হয়েছে হৃদয়। পালাগানে মজেছে শিল্প রসিকের মন। দিন শেষে শীতল সন্ধ্যায় নাটক দেখে কেটেছে সময়। সমাপনী অনুষ্ঠানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর বক্তৃতাটিও ছিল দারুণ উপভোগ্য। ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’ প্রতিপাদ্যে বাংলাভাষী তিন শতাধিক সাহিতিকে অংশগ্রহণে এ সম্মেলনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদ। তিন দিনের এ সম্মেলনের সহযোগিতায় ছিল বাংলা একাডেমি, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ। একাডেমির নজরুল মঞ্চে ঢাকা ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিনের এ আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের সমাপ্তি টানা হয়। ঢাকা ঘোষণায় অখ- মানবতায় আস্থাশীল এবং সেজন্য বর্তমান বিশ্বের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন ইউসুফ ‘ঢাকা ঘোষণা’ দেন। তিনি বলেন, আমরা সব ধরনের বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের বিরোধী এবং তাই বিশ্ব শান্তির পক্ষে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করছি। আমরা সকল মানুষের মৌলিক অধিকারে বিশ্বাসী এবং প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা তাদের অলঙ্ঘনীয় অধিকার বলে ঘোষণা করছি। আমরা মানুষের জন্য যা কিছু অকল্যাণকর তা পরিহার করে সত্য ও কল্যাণের সঙ্গে নিজেকে উৎসর্গ করা সব লেখকের কর্তব্য বলে ঘোষণা করছি। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার করছি। আমরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের লক্ষ্যে ভূমিকা পালনের আমরা অঙ্গীকার করছি। এই সম্মেলনে যেসব আলোচনা ও মতবিনিময় হয়েছে, তা বাংলা ভাষার লেখকদের ঐক্যবন্ধনে অর্থপূর্ণ অবদান রাখবেন। ঢাকা ঘোষণা ছাড়াও সমাপনী দিনের আয়োজনে ছিল তিনটি সেমিনার, নানা বিষয়ে তরুণদের অংশগ্রহণে নানা বিষয়ে কথোপকথন ও গল্পপাঠের আসর। সেই সঙ্গে মঞ্চনাটক ও লোকগানের সুরে শেষ দিনে জমজমাট ছিল সাহিত্য সম্মেলন। সমাপনী দিনের প্রথম সেমিনারের বিষয় ছিল ‘ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতিসত্ত্বা’। একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সৈয়দ আজিজুল হক। এমিরেটাস অধ্যাপক ও ভাষা সৈনিক ড. রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন ভারতের সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, বাংলাদেশের সমালোচক ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ এবং ভারতের সাহিত্যিক অমর মিত্র। মূল প্রবন্ধে সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, বাংলা ভাষার শক্তি সম্পর্কে বাঙালীর আত্মবিশ্বাস ছিল দৃঢ়। এটি কোন কৃত্রিম ভাষা নয়, এর রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য, হাজার বছরের দীপ্ত পদচারণা। এই ভাষার রয়েছে উন্নত সাহিত্য, এই ভাষার কবি পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বাঙালীর কোন গর্বের মধ্যে কোন অহেতুক ভাবাবেগ নেই, আছে যুক্তিসিদ্ধ প্রেমাবেগ। দ্বিতীয় সেমিনার হয় কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে। ‘প্রযুক্তির বিশ্বে সাহিত্যের সঙ্কট ও সম্ভাবনা’ শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক-অনুবাদক রাজু আলাউদ্দীন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত এবং ভারতের দুই লেখক প্রবীর শীল ও শ্যামল কান্তি দাস। তৃতীয় ও সম্মেলনের শেষ সেমিনার হয় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। ‘সাহিত্যের অনুবাদ, অনুবাদের সাহিত্য’ শীর্ষক সেমিনারে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন বাংলাদেশের কবি মুহাম্মদ সামাদ, অধ্যাপক নিয়াজ জামান, অনুবাদক জিএইচ হাবীব, ভারতের মৃদল দাশগুপ্ত এবং জাপানের অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে। অনেক আকাশ তাঁবুতে সমাপনী দিনেও ছিল নানা বিষয়ে দারুণ সব আলোচনা। ‘কথাপর্ব’ শিরোনামের এ আয়োজনে জনপ্রিয়ধারার লেখা, সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন, লোকসাহিত্যসহ বিভিন্ন তরুণ ও প্রবীণ সাহিত্যিকরা নিজেদের মতবিনিময় করেন। ‘জনপ্রিয়তা ও লেখকের আপোস’ শিরোনামের কথনপর্বে আলোচনা করেন কবি মাহবুব আজীজ, জাকির তালুকদার, শোয়াইব জিবরান ও স্বকৃত নোমান। এতে অতিথি ছিলেন ভারতের অমর মিত্র। সঞ্চালনা করেন নাট্যকার সাধনা আহমেদ। মাহবুব আজীজ বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক। তিনি মধ্যবিত্তদের নিয়ে লিখেছেন। তবে সেখানেও মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র সম্পূর্ণরূপে ফুটে উঠেনি। ‘সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন’ শিরোনামের কথাপর্বে আলোচনা করেন নির্মাতা ফৌজিয়া খান, চলচ্চিত্র গবেষক বিধান বিবেরু, সাংবাদিক উদিসা ইসলাম ও শোয়েব সর্বনাম। সঞ্চালনায় ছিলেন কবি মাসুদ পথিক। ‘বিশ্বায়নের কালে লোকসাহিত্য’ শিরোনামের কথাপর্বে আলোচক ছিলেন নাজিব তারেক, রাহেল রাজিব, রঞ্জনা বিশ্বাস ও রিলকে রশীদ। সঞ্চালনায় ছিলেন কবি শিহাব শাহরিয়ার। এছাড়াও দিনভর ছিল নানা আয়োজন। দুই বাংলার কবিদের পরিবেশনায় ছিল স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। লালন চত্বরে লোকগান শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের লোকসঙ্গীত শিল্পীরা। সন্ধ্যায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আব্দুল্লাহ আল-মামুন নির্দেশিত থিয়েটারের নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এছাড়া বিকেলে নজরুল মঞ্চে বঙ্গলোক পরিবেশিত রূপচান সুন্দরীর পালাটি ছিল দারুণ উপভোগ্য।
×