ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘন কুয়াশায় যশোরে নষ্ট হচ্ছে বীজতলা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

ঘন কুয়াশায় যশোরে নষ্ট হচ্ছে বীজতলা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় যশোরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোরোর বীজতলা। এর ফলে জেলায় এবার বোরো আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষকরা বলছেন, শৈত্যপ্রবাহ প্রলম্বিত হলে এ অঞ্চলের শতভাগ বীজতলা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হবে। এর ফলে বোরো চাষের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। জানুয়ারির ৪ তারিখ থেকে যশোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহের কারণে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাপমাত্রা নেমে আসে ৪-৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। সেই সাথে প্রকৃতি ঢেকে যায় ঘন কুয়াশায়। শীত-কুয়াশায় প্রকৃতি যখন বৈরী হয়ে ওঠে তখন মাঠে মাঠে প্রস্তুতি চলছে বোরো আবাদের। বিস্তীর্ণ মাঠে রয়েছে বোরোর বীজতলা। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশা সহ্য করতে পারেনি বীজতলায় থাকা এসব ধানের চারা। বেশিরভাগ স্থানেই তা নষ্ট হয়ে গেছে কোল্ড ইনজুরিতে। যেগুলো ভাল আছে তা নিয়ে চিন্তায় কৃষক। কৃষকরা বলছেন, বিগত আমন মৌসুমে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তারা লাভের মুখ দেখতে পারেননি। বোরো আবাদ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই তাই তারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। গত বছরের চেয়ে বেশি দামে ধান বীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেন তারা। তবে সম্প্রতি তাপমাত্রার এ বিরূপ প্রভাবে ধান চাষ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। বীজতলা নষ্ট হওয়ায় দ্বিতীয় দফা চারা তৈরি নিয়ে শঙ্কিত চাষীরা।সদর উপজেলার বীর নারায়ণপুরের চাষী জামাল হোসেন জানান, তিনি ৫ বিঘা জমির জন্য বীজতলা তৈরি করেন। যশোর বিএডিসি থেকে গত বছরের চেয়ে ১০ কেজির বস্তায় ১০০ টাকা বেশি দিয়ে ধান বীজ কিনে বীজতলা তৈরি করেছেন। গত কয়েকদিনের তীব্র ঠা-ায় বীজতলা সাদা হয়ে গেছে। কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে ধানের চারা গজাচ্ছে না। তিনি বলেন, শীত বিলম্বিত হলে বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। একই কথা জানান, ইছালী এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, বোরো চাষের জন্য কৃষকরা আমন ও বোরো মৌসুমে নিজস্ব উদ্যোগে ধানের বীজ সংগ্রহ করে এলেও বিগত কয়েক বছর ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে সম্ভব হয়নি। আমন ও বোরো মৌসুমে কয়েক দফা টানা বৃষ্টি ও ঝড়ের কারণে ধান বীজ সংগ্রহ করতে না পারায় বিএডিসি ও বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ধানের বীজ কিনে বীজতলা দেয়া হয়েছে। অথচ সেই বীজতলা এখন তীব্র শীতের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বীজতলা নষ্ট হলে কৃষককে দ্বিতীয় দফা বীজতলা তৈরি করে বোরো আবাদ করা ঝুঁকি হয়ে যাবে। কৃষক রফিউদ্দীন বলেন, এমনিতো ধান আবাদে তেমন কোন লাভ নেই। তারপর যদি বীজতলা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আর উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, আমনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষককে চরমভাবে লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন যদি বোরো আবাদেও লোকসান করতে হয় তাহলে আমাদের আর কোন উপায় থাকবে না। এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ধান আবাদকে টার্গেট করে কৃষক ইতোমধ্যে ৮ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় ধান রোপণের কাজও শুরু করেছেন কৃষক। তবে সাম্প্রতিক যশোরাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শৈত্যপ্রবাহে কিছু কিছু বীজতলা নষ্ট হলেও অধিকাংশ এলাকার কৃষক কোল্ড ইনজুরি থেকে রক্ষা পেতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, এবছর বোরো আবাদকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলার অধিকাংশ এলাকায় কৃষক আদর্শ বীজতলা তৈরি করেছেন। যারা আদর্শ বীজতলা তৈরি করেছেন তাদের ক্ষতি কম হচ্ছে। তিনি বলেন, বীজতলাকে কোল্ড ইনজুরি থেকে রক্ষা করতে কৃষককে জমিতে সেচ ও পলিথিং দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দু’একদিনের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়লে কৃষকের চিন্তা থাকবে না। বগুড়ায় আলুক্ষেতে লেট ব্রাইট স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া অফিস থেকে জানান, গত মৌসুমে লোকসানের পর এবার তীব্র শীতের সঙ্গে টানা ঘন কুয়াশা বগুড়ার আলু চাষীদের ওপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো নেমে এসেছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় আলু ক্ষেতে দেখা দিয়েছে পচন বা লেট ব্রাইট রোগ। ছত্রাক নাশক ওষুধ ছিটিয়েই কৃষকরা স্বস্তিতে নেই। দফায় দফায় ক্ষেতে ছত্রাকনাশক ওষুধ দেয়ায় এ নিয়ে তাদের আবাদ খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে শুরুতেই লোকসানের আশঙ্কায় পড়েছেন আলুচাষীরা। বোরো বীজতলাও বৈরী আবহাওয়ার কারণে পড়েছে ক্ষতির মুখে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। বগুড়া সদরের তিলাপাড়া এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম শঙ্কা নিয়ে নিজের আলু ক্ষেতে দুশ্চিন্তা নিয়ে ভোর থেকে স্প্রে করছেন। জমিতে ধরেছে পচন রোগ। ক্ষেতের বিভিন্ন স্থানে পচন রোগে গাছের পাতাসহ ডাল শুকিয়ে বির্বণ। গত বছর দেড় বিঘা জমিতে আলু আবাদ করে প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল। এবার আশা করেছিলেন, সে লোকসান পুষিয়ে নিবেন কিন্তু পচন রোগ তার সে আশায় ফাটল ধরাচ্ছে। শাখারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান শফিক জানালেন, তার এলাকার প্রায় ৩০ ভাগ আলু ক্ষেতে পচন বা লেটব্রাইট রোগ দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কৃষক আবু বক্কর জানালেন, তার এলাকার জঙ্গলপাড়, গোপালবাড়ি, কদিমপাড়া, চালিতাবাড়িসহ বিভিন্ন ক্ষেতে পচন রোগ দেখা দিয়েছে। এছাড়া শেখেরকলা ইউনিয়নের বালাকৈগাড়ি এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় একইভাবে আলু ক্ষেতে পচনরোগ দেখা দিয়েছে। পচন রোগে আলুর গাছ ও পাতা বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। বগুড়া আলু উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিত। জেলার শিবগঞ্জ ও সদর এলাকায় সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়া’র উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, রোদ উঠতে শুরু করায় এনিয়ে আর আশঙ্কা নেই। সামান্য কিছু জায়াগায় লেট ব্রাইট দেখা দিলেও তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে এ পর্যন্ত তারা ১৩ হেক্টর আলু ক্ষেত লেট ব্রাইটে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানতে পেরেছে। তবে মাঠ পর্যায় ঘুরে দেখা গেছে বিপুল পরিমাণ আলু ক্ষেত লেট ব্রাইট বা পচনরোগের শিকার হচ্ছে। পাবনায় বিবর্ণ বোরোর বীজতলা নিজস্ব সংবাদদাতা পাবনা থেকে জানান, একটানা শৈতপ্রবাহ ও কনকনে শীতে জেলার বোরো ধানের বীজতলা কোল্ড ডিজিজে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষকদের মতে যাকে বলা হয় কোল্ড ডিজিজে আক্রান্ত। এ দিকে বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আবাদ বিপর্যয় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন কৃষকরা। এ দিকে ধানের দাম এবার ভাল পাওয়ায় কৃষক ধান আবাদে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া বইতে শুরু করায় বোরো আবাদের জন্য প্রস্তুত বীজতলার নষ্ট হওয়ায় আশানুরূপ ফল পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিভূতিভুষন সরকার জানান, এবার পাবনার নয়টি উপজেলায় এক লাখ ৯৮ হাজার এক শ’ ২৯ টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যে ৫০ হজার তিন শ’ ৭২ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাদের মধ্যে ধরা হয়েছে হাইব্রিড জাতের এক হাজার ৬৭৮ হেক্টর, উফসি জাতের ৪৮ হাজার ৭৫ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ছয় শ’ ১৯ হেক্টর জমি। এসব ধান রোপণের জন্য বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার তিন শ’ ১৩ হেক্টর জমিতে। সেখানে কৃষক বীজতলা তৈরি করেছেন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। তিন হাজার তিন শ’ ১৩ হেক্টরের স্থলে কৃষকরা বীজতলা তৈরি করেছেন তিন হাজার তিন শ’ ৩৮ হেক্টর জমিতে। কিন্তু আবহাওয়া বিরূপ থাকায় আবাদের কিছুটা সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। পাবনা কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা লোকমান হোসেন জানান, অগ্রহায়ণের শুরুতে যদি বীজতলা তৈরি করা হয়, তাহলে শৈতপ্রবাহে বীজ-তলায় কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু কৃষক দেরিতে বীজতলা তৈরি করার কারণে এই কনকনে শীতে পড়েছে বীজতলা। ফলে বোরো ধানের বীজতলা হলুদ হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ- পরিচালক কৃষিবিদ বিভূতিভুষন সরকার জানান, ঘন কুয়াশার মধ্যে সূর্যের তাপ পেলে বীজতলার তেমন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
×