ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৮ উইকেটে জিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে টাইগারদের উড়ন্ত সূচনা

সাকিব-তামিমের নৈপুণ্যে পাত্তাই পেল না জিম্বাবুইয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

সাকিব-তামিমের নৈপুণ্যে পাত্তাই পেল না জিম্বাবুইয়ে

মিথুন আশরাফ ॥ দেশের মাটিতে ১৫ মাস পর ওয়ানডে খেলতে নামে বাংলাদেশ। আবার জিম্বাবুইয়ে নিজেদের সর্বশেষ সিরিজে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে ওয়ানডে সিরিজে হারায়। বাংলাদেশ দলের সাবেক বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক আবার এখন জিম্বাবুইয়ের প্রধান কোচ। বাংলাদেশ দলের শক্তি-দুর্বলতা সম্পর্কে ভালই জানা তার। এ বিষয়গুলো মিলিয়ে সবার ভেতরই একটা ভয় কাজ করছিল। আবার না নেতিবাচক কিছু ঘটে যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা এমন খেলাই দেখালেন, জিম্বাবুইয়ে পাত্তাই পেল না। ৮ উইকেটে জিতল বাংলাদেশ। তাতে বল হাতে ৩ উইকেট ও ব্যাট হাতে ৩৭ রান করে উজ্জ্বল সেই একজনই, সাকিব আল হাসান। তবে ব্যাট হাতে তামিম ইকবালও উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন। অপরাজিত ৮৪ রানের ইনিংস খেলেছেন। তাতে করে সহজভাবেই জিতেছে বাংলাদেশ। শীতকাল। কুয়াশায় আচ্ছন্ন শহর। যদিও সোমবার সকাল থেকেই রোদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ থাকে। কিন্তু বিকেলের পর থেকে যে কুয়াশা পড়বে তা তো সবারই জানা। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই টস জিতলে ফিল্ডিংই নেবে যে কোন দল। দিনে কুয়াশা না থাকলেও বিকেলের পর থেকে যে কুয়াশা পড়বে তাতে বোলারদের বোলিং করতে সমস্যা হবে। তাই আগে ফিল্ডিং করে প্রতিপক্ষকে অল্পের মধ্যে বেঁধে রাখা গেলেই জয় পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। পরে ব্যাটিং করা যে অনেক সহজ। বাংলাদেশ দলও তাই করল। টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু জিম্বাবুইয়ে এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে তা খেলার আগ পর্যন্ত বোঝা যায়নি। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আসা দলটি এমন দুমড়ে মুছড়ে যাবে তা ভাবাই যায়নি। কঠিন প্রতিপক্ষই তাই ভাবা হচ্ছিল। আবার দলটির কোচ এখন হিথ স্ট্রিক। যিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের বোলিং কোচ ছিলেন। কিন্তু কোনকিছুই বাংলাদেশের সামনে প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। জিম্বাবুইয়েকে উড়িয়েই দিয়েছে বাংলাদেশ। নেতিবাচক ভাবনার সঙ্গে সবসময়ই ইতিবাচক ভাবনাই বেশি কাজ করেছে। খেলাটি যে বাংলাদেশের মাটিতে হচ্ছে। তাই বাংলাদেশই সিরিজ জুড়ে যেখানে ফেভারিট, সেখানে জিম্বাবুইয়ের সঙ্গে তো জেতারই কথা। সব ভয়, শঙ্কা দূর করে দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। দেশের মাটিতে ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর যে আর ওয়ানডে খেলেনি বাংলাদেশ, সেই জড়তা কাটিয়ে ফেলেছে। নিজেদের সর্বশেষ সিরিজে যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নাস্তানাবুদ হয়েছে দল, সেই দুঃখস্মৃতিও যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। ত্রিদেশীয় সিরিজে যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার শুরুও হয়ে গেল। নতুন বছরে প্রথম ম্যাচেই জয়ও তুলে নিল বাংলাদেশ। প্রায় তিন বছর পর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান এনামুল হক বিজয়। ওপেনার সৌম্য সরকারকে বাদ দিয়ে বিজয়কে নেয়া হয়। বিজয় শুরুতেই বাজিমাত করে দেখান। প্রথম চার বল খেলে তিনটি বাউন্ডারি হাঁকান। ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করে কোঁকড়ানো শীতে গরম হাওয়া এনে দেন। দর্শকরাও ‘বিজয়, বিজয়’ ধ্বনিতে মুখরিত হন। কিন্তু ১৯ রানের বেশি করতে পারেননি বিজয়। ততক্ষণে ২৪ বলেই ৩০ রান হয়ে যায়। বিজয়ের আউটের পর তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন সাকিব। এই পজিশনটিতে সেট কোন ব্যাটসম্যান নেই। এ জায়গাটি নিয়ে সবসময়ই দলের চিন্তা থাকে। শেষ পর্যন্ত সাকিবকে এ স্থানে খেলানোর ভাবনা হয়। সাকিবও ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মতো এ স্থানে ব্যাট হাতে নেমে ঝলক দেখান। তামিমের সঙ্গে বড় জুটিই গড়েন। দুইজন মিলে দলকে এক শ’ রানের ওপরেও নিয়ে যান। যখন ১০৮ রান হয়, তামিমের সঙ্গে ৭৮ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন; এমন সময় সিকান্দারের বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে যান ১৮১ ওয়ানডে খেলা সাকিব (৩৭)। সাকিব আউট হওয়ার পর তামিম যেন নতুনরূপে ধরা দেন। মুহূর্তেই হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। সাকিব যখন আউট হন তামিমের স্কোরবোর্ডে তখন ৫৬ বলে ৪০ রান জমা ছিল। ৩টি চার হাঁকান তামিম। এরপর থেকে দ্রুতই বাউন্ডারির পর বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। দেখতে দেখতে ৯৩ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ৮৪ রান করে ফেলেন তামিম। ম্যাচও শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশ জিতে যায়। তামিমের সঙ্গী থাকা মুশফিকুর রহীম ১৪ রানে অপরাজিত থাকেন। দুইজনই ম্যাচ জিতিয়ে হাসিমুখে বের হন। জিম্বাবুইয়ে এতটাই বিপাকে পড়েছে, ১৭০ রানেই গুটিয়ে গেছে। তখনই বোঝা হয়ে যায় বাংলাদেশ ম্যাচটি জিততে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। আগে ফিল্ডিং পেলেই স্পিনে যে নাকাল করা যাবে জিম্বাবুইয়েকে, সেই ধারণা সবার মধ্যেই ছিল। তাইতো সাকিবের সঙ্গে সানজামুল ইসলামকে স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে একাদশে রাখা হয়। নাসির হোসেনও হাত ঘুরানোর সুযোগ পান। গত বছর আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে একটি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পাওয়া সানজামুলও জাতীয় দলের হয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নেমে হতাশ করেননি। ১০ ওভার বল করে ২৯ রান দিয়ে ১ উইকেট শিকার করেন। সিকান্দার রাজা ও ম্যালকম ওয়ালার মিলে যখন বড় জুটি গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন তখনই সানজামুল স্পিন দ্যুতি ছড়ান। ওয়ালারকে আউট করে দেন। তাতে জিম্বাবুইয়ে বিপাকেই পড়ে। যে বিপাকে জিম্বাবুইয়েকে আসলে ফেলে দেন সাকিব। প্রথম তিন বলেই দুটি উইকেট নিয়ে নেন। সেই যে জিম্বাবুইয়ে বিধ্বস্ত দলে পরিণত হয়ে যায়, সেখান থেকে আর বের হতে পারেনি। স্পিনারদের সঙ্গে পেসাররাও যখন গতির ঝড় তুলতে থাকেন, মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেন মিলে জিম্বাবুইয়ে ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দিতে থাকেন; তখন জিম্বাবুইয়ে আর যায় কোথায়। সঙ্গে মাঝখানে নাসির বল করতে এসে তো উইকেট না পেলেও ৫ ওভার বল করে মাত্র ১৫ রান দিয়ে ঝলক দেখান। সিকান্দার রাজা ও পিটার মুর মিলে ষষ্ঠ উইকেটে যদি ৫০ রানের জুটি না গড়তেন, প্রতিরোধ না গড়তেন তাহলে ১৫০ রান করাও জিম্বাবুইয়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। মাঝপথে অভিজ্ঞ ব্রেন্ডন টেইলরকে ফিরিয়ে দিয়েই যেন মুস্তাফিজ কাজের কাজটি করেন। এর আগে হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে ফেরান অধিনায়ক মাশরাফি। তাতে করে ৫১ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে যায় জিম্বাবুইয়ে। এরপর ৮১ রানের সময় ওয়ালারকে ফিরিয়ে দেন সানজামুল। যখন সিকান্দার ও মুর মিলে বড় জুটির শঙ্কা জাগান, তখন সিকান্দার রান আউট হয়ে যান। জিম্বাবুইয়ের ইনিংসের একমাত্র হাফসেঞ্চুরিয়ান সিকান্দার (৫২) আউট হতেই জিম্বাবুইয়ে চুপসে যায়। ততক্ষণে অবশ্য জিম্বাবুইয়ে ১৩১ রান করে ফেলে। একটা সময় গিয়ে দেড় শ’ রানও অতিক্রম করে ফেলে। যেই ১৬১ রানে যায় জিম্বাবুইয়ে, অধিনায়ক গ্রায়েম ক্রেমারকে সাজঘরে ফিরিয়ে দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করেন সাকিব। বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেটও নেন। এই সময় পর্যন্ত রুবেলের বিধ্বংসী বলের দেখা মিলছিল না। ৪ ওভারে ২২ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন রুবেল। যেই পঞ্চম ওভার করতে আসেন, রুবেলকে অন্যরূপেই মিলে। টানা দুই বলে দুই উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিকের আশাও জাগান। ৪৮তম ওভারের তৃতীয় ও চতুর্থ বলে মুর ও চাতারাকে আউট করে দিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে এক শ’ উইকেট শিকারি বোলারও হয়ে যান রুবেল। ৪৯তম ওভারের শেষ বলে গিয়ে মুস্তাফিজ যখন মুজারাবানিকে আউট করে দেন তখন জিম্বাবুইয়ের ইনিংসেরই শেষ হয়ে যায়। ৫০ ওভারও খেলতে পারেনি জিম্বাবুইয়ে। এত কম রান করে কি আর জেতা যায়। তাও আবার বাংলাদেশ খেলছে দেশের মাটিতে। পারেওনি জিম্বাবুইয়ে। বাংলাদেশের কাছে পাত্তাই পায়নি।
×