ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেজবাহর জঙ্গী হয়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে র‌্যাবের অনুসন্ধানে

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

মেজবাহর জঙ্গী হয়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে র‌্যাবের অনুসন্ধানে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর নাখালপাড়ায় জঙ্গী আস্তানায় র‌্যাবের চালানো অভিযানে নিহত তিন জঙ্গীর মধ্যে মেজবাহ দুই মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ ছিল। মেজবাহর জঙ্গী হয়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে তার পরিবার, স্ত্রী মেজবাহর পরিচিতদের জবানবন্দী ও র‌্যাবের অনুসন্ধানে। মেজবাহর পিতামাতা-ভাই বোনসহ নিকটাত্মীয়দের ঢাকায় র‌্যাব সদর দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সোমবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ নিহত অপর দুই জঙ্গীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে র‌্যাব জানিয়েছে। গত ১২ জানুয়ারি রাত দুটোর দিকে ঢাকার তেজগাঁও থানাধীন ১৩/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার ছয়তলা বাড়ি রুবি ভিলার পঞ্চম তলায় জঙ্গী আস্তানাটির সন্ধান পায় র‌্যাব। অভিযানে তিন জঙ্গী নিহত হয়। আস্তানা থেকে ৩টি আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) দিয়ে তৈরি ৩টি অত্যন্ত শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ২টি বিদেশী পিস্তল, ১৪টি ইলেকট্রিক ডেটোনেটর ও ৪টি পাওয়ার জেল (বিস্ফোরক) উদ্ধার হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে এবং তাঁকে নিরাপত্তাপ্রদানকারী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যদের বসবাস পাশেই। বাড়ির মালিক বিমানের পারসার (ক্যাবিন ক্রু) শাহ মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন আর তার ছোট ভাই সাখাওয়াত বিমানের পাইলট। বাসাটি জাহিদ হাসান ও সজীব মিয়া নামে ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গীরা। পরিচয়পত্রে থাকা ফিঙ্গার প্রিন্ট মোতাবেক জাহিদের প্রকৃত নাম মেজবাহ উদ্দিন বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। তার পিতার নাম এনামুল হক। মায়ের নামে তাহমিনা আক্তার। বাড়ি কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানাধীন হাসনাবাদ এলাকার বাদুয়ারা গ্রামে। র‌্যাব মেজবাহর পিতা-মাতা, ভাই বোন, স্ত্রী, নিকটাত্মীয়সহ অনেককেই কুমিল্লাসহ অন্যান্য জায়গা থেকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা মেজবাহ উদ্দিনের ভাই মোসলেহ উদ্দিন মেজবাহর লাশ শনাক্ত করেন। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, মেজবাহর পিতা মাওলানা এনামুল হক চাঁদপুরের কাদরা ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক। তিনি স্থানীয় একটি মসজিদের মোহাদ্দেস। মেজবাহরা চার ভাই, তিন বোন। মেজবাহ ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ। ভাইদের মধ্যে সবার বড়। সে স্থানীয় মনোহরগঞ্জের আলী নকিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে। ২০০৭ সালে ঢাকার সায়েদাবাদে একটি মোটর গ্যারেজে কাজ নেয়। পরবর্তীতে যাত্রাবাড়ী জনপদ মোড়ে মেজবাহ টায়ার শপ্ নামে নিজেই একটি মোটর গ্যারেজ চালু করে। যাত্রাবাড়ী জনপথ মোড়ে একটি মেসে বসবাস করত। ২০১৫ সালের দিকে তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। ধর্মভীরু হয়ে ওঠে। তার এমন পরিবর্তনে পরিবারের সদস্যরা তাকে সন্দেহ করে আসছিলেন। নিজ গ্রামে থাকার সময় স্থানীয় মসজিদের ইমামের ইমামতি নিয়ে প্রশ্ন তুলত। পরবর্তীতে জন বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা নামাজ আদায় করা শুরু করে। গত বছরের ২৮ মে পারিবারিকভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামের শারমিন আক্তারকে (১৮) বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী পরিবারের কাছে তার স্বামী উগ্রবাদিতায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে বলে জানায়। গত বছরের ২০ অক্টোবর মেজবাহ সর্বশেষ তার গ্রামের বাড়ি যায়। ওই সময় তার সঙ্গে দুইজন অপরিচিত যুবক ছিল। ওই দুইজন তার মায়ের ভাইয়ের চেয়েও আপন বলে পরিবারকে জানায় মেজবাহ। ছয় দিন থাকার পর গত বছরের ২৬ অক্টোবর স্ত্রী ও পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে। গত বছরের ১০ নবেম্বর মেজবাহ তার পরিবারের সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর প্রায় ২০ দিন পর সে হঠাৎ অজ্ঞাত স্থান থেকে স্ত্রী ও মাকে ফোন করে ক্ষমা চায়। জান্নাতে দেখা হবে বলে বিদায় নেয়। এ সময়ে তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা বলে জানালে মেজবাহ জানায়, সে আল্লাহর রাস্তায় চলে যাচ্ছে। এতে ভয়ে মেজবাহর পরিবার গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করে। নিখোঁজ হওয়ার আগে মেজবাহর পরিবারের দেয়া তথ্য মোতাবেক, সে সর্বশেষ দক্ষিণ সায়েদাবাদ রবিন মিয়ার মেসে ছিল। মেসের ম্যানেজার রিপন জানায়, মেজবাহ তার মেস ভাড়া নেয়। নিয়মিত নামাজ পড়ত। স্বভাব চরিত্র ভাল। তবে মাঝে মধ্যে তাবলিগের কথা বলে নিরুদ্দেশ থাকত। গত বছরের ৭ নবেম্বর তাবলিগে যাচ্ছে বলে মেস ত্যাগ করে। এরপর আর আসেনি। গত ৩ জানুয়ারি মেজবাহর ভাই ও বাবা ঢাকায় এসে মেস থেকে তার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যায়।
×