ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আতঙ্কের জাহাজ্যারচর এখন আলো ঝলমলে স্বর্ণদ্বীপ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

আতঙ্কের জাহাজ্যারচর এখন আলো ঝলমলে স্বর্ণদ্বীপ

ফিরোজ মান্না, নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপ থেকে ফিরে ॥ বঙ্গোপসাগার আর মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা ‘জাহাজ্যার চর’ ছিল দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের অভয়াশ্রম। দস্যুতা করে নিরাপদ আশ্রয় জাহাজ্যার চরেই থাকত তারা। সেখানে তারা গড়ে তুলেছিল অস্ত্রের বিশাল ভা-ার। আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল তাদের। বিশাল এই চরের তারাই ছিল রাজা। এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ভয়ে কেউ যেতেও পারতেন না। যারা বাথানে মোষ চরাতেন তারাও ছিল তাদের কাছে জিম্মি। যখন খুশি তখনই বাথান থেকে মোষ নিয়ে যেত জলদস্যুরা। এই মোষের মালিকরা আবার থাকতেন নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডে। তারাও সশস্ত্র দস্যুদের বিরুদ্ধে কিছু বলত না। পুলিশকেও কখন তারা নালিশ করেনি। বছরের পর বছর ধরে জেগে ওঠা জাহাজ্যার চরের গল্পটা ছিল এমনই। অল্প কিছু দিন হলো চরের সেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চরটিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যে চরের চেহারায় নানা রং লাগে। যখন সেনা সদস্যরা চরটিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে যায়, তখন থেকেই দস্যুরা পালাতে শুরু করে। কেউ আবার সেনা সদস্যদের হাতে আটকও হয়। এখান থেকে বিপুল অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল। সেনা সদস্যরা চরটি পাওয়ার পর এর নামকরণ করে ‘স্বর্ণদ্বীপ’। সেই থেকেই জাহাজ্যার চর নামটি ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। এখন স্থানীয়রা দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ হিসেবেই চেনে ও ডাকে। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও স্বর্ণদ্বীপের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। রবিবার সরেজমিন স্বর্ণদ্বীপে (জাহাজ্যার চরে) দেখা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কর্মকা- চালানো হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে প্রশস্ত রাস্তা আর নানা অবকাঠামো। ইতোমধ্যে ময়নামতি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ৩১ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের সব প্রস্তুতি শেষ। নির্মাণ শুরু হবে যে কোন দিন। রড সিমেন্ট ইট বালু সব সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ঝাউবন ঘেরা দ্বীপে লাগানো হচ্ছে নানা রকমের বৃক্ষ। ইতোমধ্যে সেখানে নারকেল বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ময়নামতি ক্যাম্পের সামনে লাগানো হয়েছে বটবৃক্ষসহ অন্যান্য জাতের গাছ। এখনও গাছগুলো ছায়া দিতে শুরু করেনি। তর তর করে বেড়ে ওঠছে এসব বৃক্ষরাজি। এঁটেল ও দোঁআশ মাটির সমন্বয়ে জেগে ওঠা চরে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি। স্থাপন হয়েছে মোবাইল টাওয়ার। শহরের সুবিধা তৈরি হচ্ছে কিছু দিন আগেও অন্ধকারে থাকা চরে। চারদিকে নির্মাণ কর্মযজ্ঞের শব্দই বলে দিচ্ছে ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ১৪ কিলোমিটার প্রশস্ত চরে মানব সভ্যতা গড়ে উঠছে। ট্রলার থেকে নেমেই আমরা গাড়িতে ময়নামতি ক্যাম্পে যেতে ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম। ময়নামতি ক্যাম্প হচ্ছে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অধীনে একটি ইউনিট। এখান থেকেই চোখে পড়ল চারদিকে উন্নয়ন কাজ। রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় স্থাপনার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কোথাও লোহার রড মাটি থেকে অনেক উপরে উঁকি দিচ্ছে। ভর দুপুরে ঘন কুয়াশায় ঘেরা চরে এমন কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। স্বর্ণদ্বীপে যাওয়ার আগে হাতিয়ার কিছু লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাজ্যার চরে যে দস্যুরা থাকত তারা বিভিন্ন নৌ-যান ও আশেপাশে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে সন্ত্রস্ত জনপদে পরিণত করত। লুটে নিত নানা জিনিসপত্র। তাদের ভয়ে প্রতিরাতেই জনপদ থাকত ভয়ে। মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন জাহাজ্যার চরের দু’পাশে থাকা সুবর্ণচর ও সন্দ্বীপের মানুষের মুখে মুখে রয়েছে জলদস্যুদের নিয়ে নানা ভয়ঙ্কর গল্প। নানা মিথ। বহু দিন আগে এখানে জাহাজডুবি হয়েছিল। সেই থেকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিলেন জাহাজ্যার চর। তবে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই চরটি ছিল আতঙ্কের। এই চরে প্রায় আড়াই হাজার জলদস্যুর অবাধ বিচরণ ভূমি ছিল। ওই দস্যু কাহিনী এখন অতীত। এখন চর ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন স্বপ্ন। নতুন আশা। রূপ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের। নামকরণও করা হয়েছে নতুন নামে-‘স্বর্ণদ্বীপ’। এখানেই গড়ে উঠছে সেনাবাহিনীর জন্য আন্তর্জাতিক মানের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ কারণে আতঙ্কের চর থেকে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে স্বর্ণদ্বীপের নাম। ২০১৩ সালে সরকারের পক্ষ থেকে চরটিকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর থেকেই চরটিকে নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সেনাবাহিনী। নানা প্রতিকূলতা আর বাধার মুখোমুখি হন তারা। আতঙ্কের চর থেকে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তুলতে মূলত তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে সেনাবাহিনী। এগুলো হচ্ছে- সেনা প্রশিক্ষণের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চর রক্ষা করতে বনায়ন ও আশপাশের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। এর বাইরেও রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। নোয়াখালীর সুবর্ণচরের জহির ঘাট থেকে ট্রলারে স্বর্ণদ্বীপে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। জোয়ার ভাটায় যাতায়াতের সময় কম বেশি হয়। নদীপথ ছাড়া চরে পৌঁছানোর বিকল্প নেই। যোগাযোগের এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই দুর্বার গতিতে স্বর্ণদ্বীপ গড়ে তোলার কাজ করছে সেনাবাহিনী। দ্বীপটিতে এরই মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার সেনা সদস্য উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। স্বর্ণদ্বীপের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে স্বর্ণদ্বীপকে প্রস্তত করা আমাদের কাছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। সেনাবাহিনীর উৎকর্ষ সাধন করতে চরটিকে বহুমাত্রিক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সরকারের দিকনির্দেশনা মেনে এখানে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে দুর্গম এ দ্বীপে তাঁবুতে অবস্থানের মাধ্যমে সেনা সদস্যরা তাদের যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অস্থায়ী ও স্থায়ী আবাসনের কাজ শুরু হয়। সেনাবাহিনী এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের যৌথ সহায়তায় স্বর্ণদ্বীপে দুটি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করা হয়েছে। এ শেল্টারে ২০ হাজার গ্যালন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং গ্রিন এনার্জির উৎস হিসেবে সোলার বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারে আনুমানিক ৫শ’ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। চরে বসবাসরত ও অবস্থানরত সকলের জন্য উন্মুক্ত। দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর সময় বাথান শ্রমিক ও জেলেসহ স্থানীয় জনগণ নবনির্মিত এ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছিল। শীঘ্রই আরও তিনটি সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করা হবে। এছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দুটি লেক খনন করা হয়েছে। সুপেয় পানির জন্য ১ হাজার মিটার গভীর সৌর বিদ্যুতচালিত পাম্প খনন এবং বর্ষা মৌসুমে চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। স্বর্ণদ্বীপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীর ভাঙ্গা-গড়ার হাত থেকে রক্ষা করাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে সেনাবাহিনী। এ জন্য ৭২ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা স্বর্ণদ্বীপে বড় পরিসরে বনায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ। স্বর্ণদ্বীপকে এসব থেকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনীর সীমিত বাজেট দিয়ে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে ৬ হাজার ঝাউ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। হেলিকপ্টার থেকে সিড বোম্বিংয়ের মাধ্যমে ২ টন কেওড়ার বীজ বপন করা হয়েছে। এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে আনা ডুয়ার্ফ প্রজাতির ১৫শ’ নারকেল চারার সমন্বয়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কারিগরি সহায়তায় আদর্শ নারকেল বাগান করা হয়েছে। এ বাগানের সঙ্গে মাছের খামার ও সবজি চাষ করা হচ্ছে। স্বর্ণদ্বীপ ঘিরে সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হলো আর্থসামাজিক উন্নয়ন। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য এরই মধ্যে স্থানীয় জনগণ ও সেনাবাহিনী সম্প্রীতি নামে একটি সমবায় গঠন করেছে। চরের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো-ছিটানো স্থানীয়দের গরু মোষ ও ভেড়ার বাথান দ্বীপের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে স্বর্ণদ্বীপে একটি ডেইরি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এখানে বাথানগুলোয় পালিত মোষ ও গরুর দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি দ্বীপে ভেড়া ও হাঁস পালনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দ্বীপে স্থানীয় কৃষককে সম্পৃক্ত করে ধান ও রবিশস্য চাষের কাজও শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আরও বড় পরিসরে মৎস্য, কৃষিভিত্তিক ও ডেইরি প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। দ্বীপটির ইতিহাস প্রায় ৫০ বছর আগের। এই দীর্ঘ সময়ে দ্বীপটি বসবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। দ্বীপের পাশেই রয়েছে চট্টগ্রামের স্বর্ণদ্বীপ ও নোয়াখালীর সুবর্ণচর। দুর্গম দ্বীপ হিসেবে এটা পরিচিতি দ্বীপটিকে প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
×