ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘ নয়, কবি সাহিত্যিকই গড়বেন নতুন পৃথিবী

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

জাতিসংঘ নয়, কবি সাহিত্যিকই গড়বেন নতুন পৃথিবী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এদেশের মানুষের কাছে যেমন সমাদৃত, তেমনই নন্দিত। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহমর্মিতার হাত। আমরা তা ভুলিনি। এবার সেই কীর্তিমান মানুষটি কথায় মুগ্ধ করলেন ঢাকাবাসীকে। সোমবার বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ১৯ মিনিটের বক্তব্যে কবি-সাহিত্যিকরাই নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করবেন উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জী বলেন, এখন পরিবেশ দূষণের চেয়ে বড় দূষণ মানুষের মনন ও চিন্তায়। ধর্মের ব্যবহারে পৃথিবীতে হিংস্রতা ছড়ায় মানুষ। এ কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূষণ মনুষ্যসৃষ্টি। হিংস্রতার সেই দূষণ থেকে কেউ মুক্ত করতে পারবে না- এমনকি জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানও। এটা পারবেন শুধু কবি-সাহিত্যিকরা। তারাই সৃষ্টি করবেন নতুন পৃথিবী। তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করা দিগি¦জয়ীরা ইতিহাস সৃষ্টি করেন না, তারা শুধু ইতিহাসে আশ্রয় পান। ইতিহাস রচনা করেন লেখকরা। একটি ভাল কবিতা বা গল্প পড়ার মুগ্ধতা সারাজীবনে ভোলা যায় না। তাই যে কবিতা বা গান ভাল লাগে তা বারবার পড়তে শুনতে ভালবাসি। সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জী বলেন, যখন এ সাহিত্য সম্মেলনে আসার আমন্ত্রণ পাই তখন মনে প্রশ্ন এলোÑআমি তো লেখক নই, আমি পাঠক। আমি কেন? আমি তো স্রষ্টা নই। আমি তো দর্শক। তাহলে এই সাহিত্য সম্মেলনে আমি কেন? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, যখন একটা বড় বাড়ি তৈরি হয় তখন অনেক মানুষ কাজ করে। একজন রাজমিস্ত্রি থাকেন। তাকে নানা কিছুর যোগান দেন। সেই হিসেবে বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে আমি একজন জোগালী। সেই জোগালী হিসেবে, পাঠক হিসেবে এ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছি। নিজের পাঠক পরিচয় তুলে ধরে প্রণব মুখার্জী বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পড়াশোনার সময় বেশি পাইনি। চার দশক সংসদ সদস্য ছিলাম। ২৫ বছর মন্ত্রী ছিলাম। কাজের চাপে পড়ার সময় খুব একটা পাইনি। রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে দেখলাম প্রাসাদসম বিশাল ভবন। পরিসংখ্যানবিদদের মতে, ৩৩০টি কক্ষ বিশিষ্ট এমন ভবন বিশে^ আর কোন রাষ্ট্রপ্রধানের নেই। রাষ্ট্রপতি হলে কাজ করার সুযোগ নেই। কাজ তো করেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সাংসদরা। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে পরামর্শ চাইবেন। বছরে একবার সাংসদদের ডেকে বক্তৃতা করব। এছাড়া ভারতে সরকার তৈরি হয় মানুষের ভোটে। দলও প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন। রাষ্ট্রপতির কাজ হলো নৈবেদ্যর ম-ার মতো বসে থাকা। বছরে একদিন বক্তৃতা করেন রাষ্ট্রপতি, যার ফুলস্টপ থেকে কমা পর্যন্ত পুরোটাই মন্ত্রিসভার তৈরি করে দেয়া। তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেই একটি কাজ খুঁজে পেলাম। প্রচুর বই রয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। প্রচুর কাগজ, দলিল দস্তাবেজও সেখানে। আছে ইতিহাসের প্রচুর উপাদান। যেসব পড়তে তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল টার্ম লাগবে। এতদিন তো সময় পাওয়া যাবে না। তার আগেই ঈশ^র আমাকে ডেকে নেবে। বলবেন, এসো আমার কাছে। তাই আমি দেরি না করে পড়তে শুরু করলাম। রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগে অনেকগুলো বই পড়ার সুযোগ পেলাম। সম্মেলনে ঢাকা ঘোষণার প্রসঙ্গে টেনে ভারতের সদ্য বিদায়ী এই রাষ্ট্রপতি বলেন, পৃথিবীর কদর্য এই চেহারাটার পরিবর্তনে অঙ্গীকারাবদ্ধ লেখকরা। যে পৃথিবীতে হিংস্রতার শিকার হচ্ছে মানুষ। যে পৃথিবীতে একেকটা বড় যুদ্ধে যত মানুষ মারা যায় সেই পৃথিবীতে সন্ত্রাসবাদের কারণে তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। প্লেন হাইজ্যাক হয়ে গিয়ে তা লিভিং বোমে পরিণত হয়। আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সেই লিভিং বোম্ব দিয়ে আত্রমণ করা হয় পেন্টাগনে। বেলা সাড়ে তিনটায় বাংলা একাডেমি আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন প্রণব মুখার্জী। কালো প্রিন্স কোট পরে গাড়ি থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের পরম সুহৃদ ভারতের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। নজরুল চত্বরে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের আহ্বায়ক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, প্রধান সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন ইউসুফ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। নজরুল মঞ্চে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে মঞ্চে আসেন বিশেষ অতিথি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ভারতের বরেণ্য চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ঝাড়খ-ের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী সরযূ রাই প্রমুখ। সমাপনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে উপজীব্য করে লেখা স্বরচিত কবিতা ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২’ পাঠ করেন কবি কামাল চৌধুরী। এ মঞ্চ থেকে সম্মেলনের ঢাকা ঘোষণা পাঠ করেন সম্মেলনের সমন্বয়কারী নাসির উদ্দীন ইউসুফ। প্রণব মুখার্জীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সাহিত্য সম্মেলনের আরেক সমন্বয়কারী এএসএম সামছুল আরেফিন। আর প্রণব মুখার্জী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। বাংলাভাষার গৌরবের কথা উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জী বলেন, আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে বাংলা ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাপ্তিতে বাংলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় প্রতিষ্ঠা পায় ভাষার অধিকার। ভাষা আন্দোলনের সেই সব শহীদের কাছে আমরা ঋণী। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে তারা রক্ষা করেছেন। তারাই এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে। তারা আগ্রাসনকারীদের হাতে ইতিহাসকে লুট হয়ে যেতে দেননি। সেই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ভাষা সাহিত্য সম্মেলন হবে না তো কোথায় হবে! প্রণব মুখার্জী আরও বলেন, বাংলা সাহিত্য শুধু তার কল্পনা, চিন্তা-প্রতিভার প্রতিফলন নয়, তার মধ্য দিয়ে বিশ^ মানবতার প্রতিফলন ঘটে। সভ্যতার ইতিহাসের দিক নির্ণয় করেছেন সেই সমস্ত মানুষÑপ্রফেট, ক্রাইস্ট, বুদ্ধা। এই ইতিহাস কখনোই মুসোলিনী, হিটলার বা স্ট্যালিনের মতো মানুষরা সৃষ্টি করেনি। ইতিহাস সৃষ্টি করেন শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিরা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক। কিন্তু তাদের মনে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। আমাদের সমাজে ব্যাপক সমতা রয়েছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্য হচ্ছে কিন্তু তারপরেও সমাজের যে কোন স্তর থেকে যে কোন ব্যক্তি তার মেধার দ্বারা যে কোন উচ্চতায় নিজের স্থান করে নিতে পারে। এটা আমাদের বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার খুব উল্লেখ যোগ্য দিক। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এ ধরনের উৎসব যত বেশি হবে আমার তত বেশি সংগঠিত হবো। আমাদের পথচলাতে সাহস ও শক্তির উৎস হবে এ ধরনের সাহিত্য সম্মেলন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্ক বহুমুখী ও বহুমাত্রিক। বর্তমানে সেই সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় আসীন। প্রণব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রথম সফর ছিল বাংলাদেশ। আবার সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবেও প্রথম সফর করলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা আমরা বারবার উপলব্ধি করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তার মমত্ববোধ আমাদের আন্দোলিত করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এ সম্মেলনে আলোচনায় আমরা বহু কিছু শিখেছি। তবে তার চেয়েও বড় কথা আমরা পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জেনেছি। মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় অজানাকে। জানাশোনা হলে অজানার শঙ্কাও কেটে যায়। ভয় কেটে গিয়ে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এ সম্মেলন সামনের দিনগুলোতে শুধু বাঙালিত্বের গৌরবকেই স্মরণ করবে না বরং সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশনা খুঁজে নেবে। শামসুজ্জামান খান বলেন, সংস্কৃতি আদান প্রদান জরুরী। সেজন্য দুই দেশের সংস্কৃতি দুদেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে দেখা যায় কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখা যায় নাÑ এমন একপাক্ষিক অবস্থা হলে এই সাহিত্য সম্মেলনগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা কাটবে না। যোগেন চৌধুরী বলেন, বাংলা ভাষাকে উজ্জীবিত করবে প্রাণ জোগাবে এ ধরনের সম্মেলন। এ সম্মেলন সারা বিশে^র মানুষকে কাছে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে এ ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আলোচনা শেষে ছিল সঙ্গীত পরিবেশনা। এ পর্বে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। গেয়ে শোনান ‘ওগো দুঃখ জাগানিয়া তোমায় গান শোনাবো’ ও ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’ প্রতিপাদ্যে দুই বাংলার সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদ। সহযোগিতায় ছিল বাংলা একাডেমি, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ।
×