ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আবদুল কুদ্দুস

২০১৮ সাল ॥ নির্বাচনের বছর

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

২০১৮ সাল ॥ নির্বাচনের বছর

পৃথিবীর নানা দেশে নির্বাচনের পূর্বে রাজনীতির মাঠ বেশ সরগরম হয়ে ওঠে। এটি খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেমন, ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত শব্দ ‘ণড়ঁঃযয়ঁধশব’ শব্দটি ২০১৭ সালের অক্সফোর্ড ইংরেজী অভিধানের বর্ষসেরা শব্দ হিসেবে স্থান পেয়েছে। শব্দটির অর্থ হলো ‘তারুণ্যের প্রভাব বা কার্যক্রমে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক খাতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন।’ সেপ্টেম্বর, ২০১৭তে নিউজিল্যান্ডের নির্বাচনেও এই শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ সম্ভাবনাময় তরুণ। এই তরুণদের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কোন কাজ করছে কী? তরুণদের জন্য কোন রাজনৈতিক প্রণোদনার মডেল তারা তৈরি করতে পারছে কী? নাকি শুধু তাদের একটি প্রত্যাশা- ভোট দাও, ক্ষমতা দাও, নেতার রাজনীতির ঢাল হয়ে অকাতরে প্রাণ দাও! দুর্জনদের বাদশা বানাও! বাংলাদেশের নির্বাচনী বছরের এ রকম হালচাল নিয়েই এই লেখার প্রয়াস। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক এমনকি সাধারণ জনগণ বলেছেন ২০১৮ সাল বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের বছর। এই বছরের অনেক কাজই নির্বাচনকে মাথায় রেখে করা হবে। হোক সেটি সরকারী অথবা বেরসকারী কাজ। বিএনপির নেতারা কেউ কেউ বলছেন যে, তারা নির্বাচনে আগাম জয়লাভ করেই বসে আছেন, শুধু তাদের একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দরকার। আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলছেন, তাদের জরিপে ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। এসব ব্যক্তিগত কথোপকথন বাদেও নির্বাচনের বছরকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান নির্বাচন সংক্রান্ত নানা ধরনের জরিপ ও গবেষণা চালিয়েছে বলে মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে বিশদভাবে এ সব জরিপের বিষয়ে জানা যায়। যেমন, ‘বাংলাদেশ ২০১৮, প্রাক পূর্বাভাস’ শীর্ষক ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি জরিপ থেকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, রাজনৈতিক সঙ্কট এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যতবিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল বাকি ২৩ শতাংশ খালেদা জিয়ার প্রতি। জরিপে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ ১০০ আসনে জয়ী হতে পারে। আবার শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে রেখে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ বিজয় লাভ করবে। জরিপে বলা হয়েছে, দেশের মাত্র ১১ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে সৎ। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশের মাত্র ৩ ভাগ উন্নয়ন হয়েছে, ১০ ভাগ উন্নয়ন হয়েছে এরশাদের নেতৃত্বে, আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের ৮৭ ভাগ উন্নয়ন হয়েছে। বিএনপি কর্তৃক একটি বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত জরিপের ফলাফলে এবং গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে ৭৭টি সাংগঠনিক টিমের মাঠপর্যায়ে সফর ও কর্মিসভা করে যে ফলাফল পেয়েছে তাতেও দেখা যায় যে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন করলে বিএনপি ১১০টির বেশি আসন পাবে না। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে বিএনপি ২১০ আসনেরও বেশি পদে বিজয়ী হবে। এসব জরিপ আসলে সবই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিচালিত। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কল্যাণে, দেশের উন্নয়নে কী ধরনের কৌশল নেয়া উচিত? মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গঠনে কী করা দরকার? কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে কেমন পদক্ষেপ নেয়া দরকার? সামাজিক ও পারিবারিক নৈতিক অবক্ষয় রোধে কেমন নীতি হওয়া উচিত? সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য কী করতে হবে, এমন কোন বিষয়ে কোন রাজনৈতিক দলই জরিপ বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত করেনি। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এসব জরিপ হয়েছে গ্রাম বাংলার জনবহুল কোন স্থানে। যেমন, হাট-বাজার, শহর-নগর, গঞ্জ, ইটভাঁটির শ্রমিক, মিল, কারখানা ইত্যাদিতে কর্মরত মানুষের মাঝে। জরিপের ব্যাপারে আমার এলাকা রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের সূর্যপাড়া গ্রামের এমন কয়জন ইটভাঁটির শ্রমিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ঘটনাটি গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের হবে। তারা বলেছেন ভাই আমরা ভয়ে আছি! আমি বললাম কেন? কী হয়েছে ভাই? জরিপে অংশগ্রহণকারী তাদের একজন বললেন- ‘কয়েকজন লোক একটি গাড়িতে করে আমাদের ইটভাঁটিতে আসল। দেখতে সাহেবদের মতো। এরপর একটি প্রশ্নপত্র বের করে উপস্থিত আমাদের অনেককে নির্বাচন বিষয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করল। সবশেষে একটি প্রশ্ন করল সেটি হলো, যে আমি কোন দল করি, বিএনপি না আওয়ামী লীগ? সম্ভবত তারা বিএনপির লোকজন ছিল। তাই ভবিষ্যতে কী হবে না হবে ভেবে আমি বললাম, আমি কোন দল করি না! ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না তো? ওরা তো আমাদের নাম লিখে নিয়ে গেছে! লোকটির ভীত সন্ত্রস্ত সেই জবাব থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, ওই সমস্ত মানুষ দেশে কোন গোলমাল পছন্দ করেন না। এবং এও প্রমাণ মিলে যে, শুধু নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর ভর করে কোন দল ক্ষমতায় অধিষ্টিত হতে পারবে না। কেননা জনগণ শান্তির পক্ষে। জনগণ উন্নয়নের পক্ষে। পেট ভরে খাবার, উন্নয়ন, শান্তি, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি যেখানে, জনগণ সেই দলের। বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, মানবসম্পদসহ সকল কাজের প্রচারে উন্নয়নের সুর ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। এই ধরুন, দেশীয় তৈরি একটি সিমেন্ট এর বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে- ‘আমার ‘ক’ সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পদ্মা সেতু, আমাদের সিমেন্ট রফতানি হচ্ছে তিন-চারটি মহাদেশের কয়েক ডজন দেশে, দেশ অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা- ভাবা যায়!’ সেলফোন কোম্পানি থেকে শুরু করে, ব্যাংক-বীমা, সিরামিক, কসমেটিকস, নির্মাণশিল্প , কৃষিজ যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেলসহ সকল প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের প্রচার-প্রসারে থিম হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের দুর্বার উন্নয়নের ‘হ্যাঁ’ সূচক ধ্বনি। উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে তুলছেন তাদের সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে সবাই হয়েছেন সাথী। বাণিজ্য, উন্নয়ন ও রাজনীতির একজন গবেষক হিসেবে এমন সম্ভাবনাময় দেশের প্রতিটি পজিটিভ নতুন দিনের আলোতে সকলের মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু যেদিন কোন বড় রাজনৈতিক দলের নেতার মুখে শুনি নির্বাচনের বছরে উন্নয়নকে হত্যা করে, উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে গণতন্ত্রের নামে স্বার্থান্বেষী দলতন্ত্র বা কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তখন ভয় হয়! আবার আমাদের সোনার বাংলাদেশ কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার শিকার হয়ে পেছনে ফিরে যায় কিনা! জ্যামিতির জনক ইউক্লিড তার ১৩ খ-ের ‘ঊষবসবহঃং’ গ্রন্থে ৪৬৫টি অনুমিত সিদ্ধান্তের প্রমাণ করে জ্যামিতিকে দিয়েছেন উচ্চতর স্থান। তার ওই স্বতঃসিদ্ধসমূহের একটি হলো- ‘পূর্ণ তার অংশের চেয়ে বড়।’ রাজনীতির ক্ষেত্রে ইউক্লিডের এই স্বতঃসিদ্ধের শিক্ষা হলো, যে দর্শনটি বাংলাদেশে পূর্ণরূপ পেয়েছে তা আংশিক যে কোন দর্শন বা ঘটনার থেকে বড়। যেমন বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পূর্ণ রূপ ধারণ করেছে। সুতরাং উন্নয়নের অংশ বিশেষের দিকে যারা স্বপ্ন দেখে সেইদিকে ফিরে যাওয়ার সময় শেষ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা তার সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে ১২ জানুয়ারি, ২০১৮ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ওই ভাষণে তিনি বলেছেন, এই বছরের শেষ নাগাদ সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে থাকবে একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। সেই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে এবং একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে এও আহ্বান করেন যে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনকারী সকল রাজনৈতিক দল যেন একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং নির্বাচন সামনে রেখে কোন সংঘাত বাংলাদেশের মাটিতে হোক তা এদেশের জনগণ চায় না। ভোটের রাজনীতিতে আর কোন মানুষের প্রাণ যাক সেটিও কেউ চায় না। নির্বাচনের বছরে দেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সোনার বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিরাজ করুক অনাবিল শান্তি। লেখক : শিক্ষক, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
×