ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মীরসরাইয়ে রোগ শনাক্তের ব্যবস্থা নেই

আর্সেনিক ঝুঁকিতে এক লাখ পরিবার

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

আর্সেনিক ঝুঁকিতে এক লাখ পরিবার

নিজস্ব সংবাদদাতা, ১৪ জানুয়ারি, মীরসরাই, চট্টগ্রাম ॥ মীরসরাইয়ে নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক থাকায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে প্রায় এক লাখ পরিবার। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা ও পর্যাপ্ত গভীর নলকূপের অভাবে উপজেলায় আর্সেনিকবাহী রোগ ইতোমধ্যে সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ ২০০২-২০০৩ সালে গ্রামের নলকূপগুলোর আর্সেনিক পরীক্ষা ও ৪০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে নলকূপের পানি পরীক্ষা ও আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে গত একযুগের বেশির সময় ধরে মীরসরাইয়ে আর্সেনিক রোগের আক্রান্ত রোগীর কোন পরিসংখ্যান নেই উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০২-০৩ অর্থবছরে উপজেলার ৭৫ হাজার ৩৬৬ পরিবারের ৩২ হাজার ৪৮০টি নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে। নলকূপগুলোর পানিতে গড়ে ৩৯.৭৭ মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৩৩টি নলকূপের প্রতিলিটার পানিতে .০৫ মিলিগ্রামের অধিক মাত্রায় আর্সেনিকের শনাক্ত করে নলকূপগুলোর পানি পান না করতে লাল রং লাগানো হয়েছে। মীরসরাই পৌরসভায় শতকরা ৬৬.৮৩, খৈইয়াছড়ায় ইউনিয়নে ৬৬.২৯, মায়ানী ইউনিয়নে ৫৬.১১, মীরসরাই সদর ইউনিয়নে ৬০.৯৬, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নে ৫১.৭৯, ওচমানপুর ইউনিয়নে ৫১.২০, ধুম ইউনিয়নে ৫১.০৯, কাটাছড়া ইউনিয়নে ৪৭.৬৬, হাইতকান্দি ইউনিয়নে ৪৫.৩৩, দূর্গাপুর ইউনিয়নে ৪৪৫.০৫, মঘাদিয়া ইউনিয়নে ৪০.৩৪, মিঠানালা ইউনিয়নে ৩৯.৮৫, ইছাখালী ইউনিয়নে ৩৯.১৭, সাহেরখালী ইউনিয়নে ৩০.৩৬ ভাগ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক শনাক্ত করেছে আর্সেনিক শনাক্তকারী টিম। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কেএম সাঈদ মাহমুদের মতে, মীরসরাইয়ে আর্সেনিক থেকে মুক্তি পেতে এক লাখ পরিবারের প্রতি ১০ পরিবারের জন্য ১টি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা। সেই হিসেবে উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ১৪ বছরে তারা মাত্র ৪৪১টি গভীর নলকূপ স্থাপন করতে পেরেছেন। জানা গেছে, ২০০২-০৩ সালে সরকারীভাবে আর্সেনিকের ওপর জরিপ চালানোর আগে ২০০১ সালে মীরসরাইয়ে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক নিয়ে জরিপ চালায় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা। ওই সময় পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ধরা পড়লে সুদ মুক্ত ঋণে মীরসরাই সদর ও উপকূলীয় ইছাখালী ইউনিয়নে চার লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক দুইটি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করে। প্ল্যান্টগুলো থেকে প্রতি কলসি পানি ৩ টাকা দামে সরবরাহ করা হয়। মীরসরাই সদরের প্ল্যান্টটি দিয়ে ৭০-৮০ পরিবারের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মিটলেও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। বর্তমানে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা সঙ্কটে সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। ইছাখালী ইউনিয়নের প্ল্য্যন্টটির বিশুদ্ধ পানি ওই এলাকার জনগণ কিনে পান না করায় প্ল্যান্ট মালিকের লোকসান দেখা দেয়। প্ল্যান্ট মালিক আবুল কালাম আজাদ জানান, এলাকার জনগণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলেও অল্প দামে আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করতে চাইছে না। ফলে প্রশিকার এক লাখ ১৯ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০০৯ সালে প্ল্যান্টটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মীরসরাইয়ে প্রশিকার কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় এ বিষয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সরজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় আর্সেনিকের ঝুঁকি থাকলেও এখন কোথাও কোন নলকূপে আর্সেনিক শনাক্তকরণ চিহ্ন নেই। ২০০১ সালে একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা পানি পরীক্ষার মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত নলকূপগুলোতে লাল চিহ্ন দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও সে চিহ্নগুলো এখন মুছে গেছে। ফলে উপজেলার হাজার হাজার মানুষ এখন ওই নলকূপগুলোর আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে যাচ্ছে। মীরসরাই মাতৃকা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ডাঃ জামশেদ আলম জানান, আর্সেনিক বিষ মানবদেহে পচন রোগ, কিডনীর সমস্যা, ক্যান্সার, হাত পায়ের তালুতে চর্মরোগের সৃষ্টি করতে পারে। তিনি আরও বলেন, আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং এ রোগ থেকে মুক্তির জন্য উপজেলাজুড়ে পর্যাপ্ত গভীর নলকূপ স্থাপন খুবই জরুরী বলে মনে করেন তিনি। মীরসরাই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কেএম সাঈদ মাহমুদ জানান, মীরসরাই উপজেলা আর্সেনিকের মারাত্মক ভয়াবহতার মধ্যে রয়েছে। উপজেলার প্রায় এক লাখের বেশি পরিবারের অধিকাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। এতে আর্সেনিকোসিস রোগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্সেনিকোসিস থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন গভীর নলকূপ স্থাপন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার। কিন্তু এর কোন ব্যবস্থাই মীরসরাইতে নেই। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যয়বহুল হওয়ায় এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না উপজেলাবাসী। সরকারীভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। সরকারী বরাদ্দ না থাকায় নলকূপের পানি পরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি।
×