ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো হৈ হুল্লোড়, আলো ঝলমলে রাত

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো হৈ হুল্লোড়, আলো ঝলমলে রাত

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ সাক্রাইন উৎসব আশ্চর্য রঙিন। আনন্দঘন। প্রতিবারের মতো এবারও ঐতিহ্যবাহী উৎসবে মেতেছে পুরান ঢাকা। রবিবার ছিল প্রথম দিন। এদিন ছেলে বুড়ো নারী পুরুষ সকলেই উঠে এসেছিলেন বাসার ছাদে। সেখান থেকে রং-বেরঙের ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়া। কাটাকাটি খেলা দিনভর। নাচ গান ছিল। ছিল পিঠাপুলির আয়োজন। আর সন্ধ্যায় আলোর ফোয়ারা। ফায়ারওয়ার্কস। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার! মূলত একদিনের উৎসব। পঞ্জিকার হিসাবে গ-গোল থাকায় দুইদিনে গড়িয়েছে। স্থানীয়দের আরেকটি অংশ আজ সোমবার উৎসব উদযাপন করবে। সাক্রাইন উৎসব নাম হলেও, আদতে এটি পৌষ বিদায়ী উৎসব। মাসের শেষ হয়েছে শনিবার। রবিবার থেকে মাঘ। মাঘের প্রথম দিন পৌষকে বিদায় জানানো হয়। পৌষসংক্রান্তি সম্পর্কে অনেকেই অবগত। সেই সংক্রান্তি শব্দের বিবর্তনে এসেছে সাক্রাইন। ঠিক কবে থেকে সাক্রাইন উদযাপিত হচ্ছে সে তথ্য নিশ্চিত করে জানা যায় না। যতদূর তথ্য, মোগল আমলে বাংলায় উৎসবটির প্রচলন। ঢাকার নবাবরা এর সূচনা করেন। পৌষের শেষ এবং মাঘের শুরুর ক্ষণে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করতেন। চলত খাবার-দাবারের আয়োজন। সেই ঐতিহ্য মেনে এখন পুরান ঢাকায় উৎসবটি উদযাপন করা হয়। উৎসবের রং বেশি দৃশ্যমান হয় গে-ারিয়া, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, চকবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুরসহ কয়েকটি এলাকায়। এলাকাগুলো ঘুরে মনে হয়েছে এ শহর কেবলই হাসিরাশি আনন্দের। কোন ঘরে বেদনা নেই। সব ঘর উৎসবের এক একটি কেন্দ্র। সাক্রাইনের প্রধানতম অনুসঙ্গ ঘুড়ি। সকাল হতেই প্রতি বাড়ির ছাদে অবস্থান নিতে থাকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। বিশেষ করে তরুণ ও শিশু কিশোরদের আনন্দ যেন ধরে না। বিভিন্ন আকার আকৃতির ঘুড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হতে দেখা যায় তাদের। তারপর ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। হরেক রকমের ঘুড়ি আকাশ এক রকম ঢেকে দেয়। কিছু ঘুড়ি পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি। কিছু আবার পলিথিন দিয়ে। বাঁশের পাতলা চটি অথবা নারিকেলের শলা দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়। ঘুড়ির আবার অনেক নাম। এদিন আকাশে উড়তে দেখা যায় পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার, ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। ঘুড়ির মতো বিভিন্ন নাম আছে নাটাইয়ের। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়াÑ কত কত নাম! ঘুড়ির ‘লেঞ্জা’ তৈরিতেও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটানো হয়। ঘুড়ির লেজ বা লেঞ্জা দারুণ ঢেউ তুলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই ঢেউ, যে ঘুড়ি ওড়ায় না, তারও বুকে এসে লাগে! ঘন হয়ে উড়তে থাকা রং-বেরঙের ঘুড়ি আকাশকে শুধু নীল থাকতে দেয় না। স্থির হয়ে থাকতে দেয় না। উৎসবের রঙে সাজায়। বহুদূর থেকে এই দৃশ্য দেখা যায়। পথচারীরা তাই নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটার কথা ভুলে যান। হাঁটেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। কী যে আনন্দ নিয়ে ঘুড়ি দেখেন তারা! ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবটি ভাল দেখা যায় বাড়ির ছাদ থেকে। বাড়ির বড়রাও তাই আর বাড়িতে ছিলেন না। ছাদের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালার গ্রিল ধরে ঘুড়ির ওড়াউড়ি দেখছিলেন এমনকি বুড়োরা। অবশ্য সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো মূল কথা নয়। কাটাকাটিতেই যত আনন্দ। এটি বলা চলে প্রধান আকর্ষণ। না, ঝগড়াঝাটি নয়। শত্রুতা নয়। এ লড়াই চলে হাসিমুখে। প্রথমে সুতোয় সুতোয় প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়া হয়। তার পর নিজ নিজ দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও কৌশল কাজে লাগিয়ে কাটাকাটি খেলা। যুদ্ধে পরাজিত ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দূরে আরও দূরে চলে যায়। অন্য কোন বাসার ছাদে বা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সুতো কাটা ঘুড়িকে অনুসরণ করে পাড়ার দুরন্ত ছেলেমেয়েরা। ঘুড়িকে নিজের করার এই চেষ্টাও চোখে পড়েছে কিছু সময় পর পর। পরদিন কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়ি ওড়ানো হয় আকাশে। এভাবে কয়েকদিন চলে ঘুড়ি উৎসব। কাটাকাটি খেলার জন্য ঘুড়ির সুতো মজবুত হওয়া জরুরী। একইসঙ্গে ধারালো হতে হয়। ঘুড়ির সুতো ধারালো করার প্রক্রিয়াটিকে বলে মাঞ্জা দেয়া। আগেই মাঞ্জা দেয়ার কাজ সেরে রেখেছিলেন ‘যোদ্ধারা।’ গে-ারিয়ার এলাকার একটি পাঁচতলা বাড়ির ছাদে কথা হয় আরিফ সোহান ও শহীদের সঙ্গে। স্থানীয় তিন যুবক জানান, একেবারে বালক বয়স থেকে তারা সাক্রাইন উৎসব উদযাপন করে আসছেন। সবচেয়ে বেশি মজা হয় এই উৎসবে। এবার শীতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে কেউ থেমে নেই বলে জানান তারা। সন্ধ্যায় আবার আরেক রূপে ধরা দেয় সাক্রাইন। ঘুড়ি ওড়ানোর পরিবর্তে শুরু হয় ফায়ারওয়ার্কস। আতশবাজির আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রঙিন হয়ে ওঠে আকাশ। একটির চেয়ে অন্যটি আরও বর্ণিল। বিপুল জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। চলে পটকা ফাটানো। মুখ দিয়ে কেরোসিন ছুড়ে তরুণরা আগুনের সঙ্গে খেলেন। আগুন কু-লি পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। না, কোন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। যায় না। সান্ধ্য আয়োজনে ছিল ভরপুর নাচ গান। উচ্চৈঃস্বরে গান বাজানো হচ্ছিল অধিকাংশ বাসার ছাদ থেকে। ফরাশগঞ্জের লালকুঠিতে ছিল একই রকম আয়োজন। এখানে নতুন ঢাকা থকে অনেকেই আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। তাদের একজন সুদেষ্ণা। সিটি কলেজের শিক্ষার্থী। বললেন, ফেসবুকে সাক্রাইন উৎসব উদযাপনের ছবি দেখেছি অনেক। এরপর থেকেই অপেক্ষা করেছিলাম, কবে যোগ দিতে পারব। আজ সম্ভব হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ সোমবারও অনেকে সাক্রাইন উৎসবে মাতবেন। যারা এই উৎসবটি সম্পর্কে জানেন না তাদের জন্য ভাল সুযোগ। ঘুরে আসুন। একবার দেখলে ভুলতে পারবেন না কোনদিন। হ্যাঁ, এত আনন্দঘন একটি আয়োজন!
×