ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

বহুমাত্রিক আয়োজনে প্রাণবন্ত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

বহুমাত্রিক আয়োজনে প্রাণবন্ত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন

মনোয়ার হোসেন ॥ কেমন করে সাতচল্লিশের দেশভাগ চিহ্ন রেখে গেল বাংলা সাহিত্যে? ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফলে সাহিত্যচর্চায় বাগ্ বদলের চিত্র উঠে এলো আলোচনায়। গৌতম ঘোষের মতো বিখ্যাত নির্মাতার কথনে সুলুক সন্ধান করা হলো সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের। বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের ২০০ বছরের ধারাবাহিকতার বিষয়ে আলোচনা করলেন ইতিহাসবিদসহ বিশিষ্টজনরা। সেই সঙ্গে ছিল গল্পকারের স্বরচিত গল্পপাঠ ও কথাসাহিত্যবিষয়ক কথন। দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের অংশগ্রহণে সাহিত্যনির্ভর তিনটি সেমিনারের পাশাপাশি শিল্পকে আলিঙ্গন করে মঞ্চস্থ হয়েছে ঢাকা থিয়েটারের নাটক ধাবমান। রবীন্দ্র চত্বরে কবিতা পাঠ করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের কবি ও শিল্পীরা। লালন চত্বরে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের শিল্পীদের কণ্ঠে ভেসে বেড়িয়েছে লোকসঙ্গীতের মরমী বাণী। বহুমাত্রিক আয়োজনে এভাবেই প্রাণবন্ত রূপ পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রবিবার। আজ সোমবার তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের শেষ দিন। এদিন বিকেলে সম্মেলন প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন ভারতের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’ প্রতিপাদ্যে দুই বাংলার তিন শতাধিক সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদ। সহযোগিতায় রয়েছে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ। রবিবার হাড় কাঁপানো শীতের সকালে প্রথম সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়নে। ‘বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের অভিঘাত’ শীর্ষক এ সেমিনারে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পর সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা থেকে রচিত কথাসাহিত্যে ‘অভিঘাত বড় ঐতিহাসিক’ বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ও ভারতের কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কবিরা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন ভারতের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক প্রাবন্ধিক ড. রামদুলাল বসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান, ত্রিপুরার কবি দেবব্রত দেব রায়, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার এবং ভারতের কবি ও লেখক বিথী চট্টোপাধ্যায়। সেলিনা হোসেন তার ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ ও ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাসের উদাহরণ টেনে বলেন, দেশভাগের অভিঘাতে রচিত গল্প, কবিতা ও উপন্যাসে মানব জীবনের বিপর্যয়, হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার চিত্রটি বার বার উঠে এসেছে। সত্তর বছর কেটে গেছে, জীবনের এসব গল্পই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, হাসান আজিজ হকের ‘আগুন পাখি’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ইছামতির এপার-ওপার’ কিংবা মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’ নামের সৃষ্টিকর্মে সেই বেদনার চিত্রায়ন ঘটেছে। বিথী চট্টোপাধ্যায় বলেন, দেশভাগ শুধু বাংলা সাহিত্যকেই প্রভাবিত করেনি। এই দেশভাগের কারণে বদলে গেছে তৎকালীন লেখকদের লেখালেখির ধরনও। নিজের অজান্তেই শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখকদের লেখনীতে পরিবর্তন এসেছে। শুধুমাত্র দেশভাগের করুণ পটভূমির ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে অনেক গল্প-কবিতা ও উপন্যাস। রামদুলাল বসু বলেন, হিন্দু-মুসলমানের স্বতন্ত্র বাসস্থান হবে- এই তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়েছিল। তবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের তত্ত্বটি ব্যর্থ হয়ে যায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। ধর্মের চেয়ে ভাষা বড়Ñ এই বিষয়টির প্রমাণ হয়েছে বাংলাদেশের জন্মের মাধ্যমে। এখন এই তত্ত্বের দর্শনের দিকটি আমাদের ভাবতে হবে। দেশভাগের অভিঘাতে রচিত সাহিত্যে বাঙালীর সামাজিক চিত্র কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, চলমান জীবনের ছবি কতটা প্রতিফলিত হয়েছে, তা এখন বিবেচ্য বিষয়। দেশভাগের প্রেক্ষিতে রচিত কথাসাহিত্যের পটপরিবর্তন বা বাগ্বদল একটি ঐতিহাসিক ফলশ্রুতি। সাতচল্লিশের পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বঙ্গদেশ বলে যে আলাদা একটি ভূখন্ড পেল-তা এখনও অখন্ড রয়েছে। দেশভাগের অভিঘাতে রচিত কথাসাহিত্যে বিষয়টি বার বার চিত্রিত হয়েছে। দেশভাগের অভিঘাতে রচিত শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, শওকত আলীর ‘ওয়ারিশ’, আনোয়ার পাশার ‘নীড় সন্ধানী’র পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ‘সওদাগর’, অতীন বসুর ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর মতো উপন্যাসের নানা চরিত্র, কাহিনী নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। দুপুরে একই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাহিত্য ও চলচ্চিত্র’ শিরোনামের দ্বিতীয় সেমিনার। এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চলচ্চিত্র গবেষক সাজেদুল আউয়াল। ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন, ভারতের কবি সুবোধ সরকার, নারী নির্মাতা শামীম আখতার, পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোনালিসা দাস ও বিথী চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের তুলনামূলক আলোচনায় গৌতম ঘোষ বলেন, মগজের বিবেচনায় পাঠক বা দর্শক সাহিত্যকে একভাবে নেবে, চলচ্চিত্রকে গ্রহণ করবে ভিন্নভাবে। সাহিত্যের বর্ণ, শব্দ, বাক্যকে পাঠক যেভাবে নেবে, চলচ্চিত্রে এসে পাঠক তা নেয় ঠিক উল্টোভাবে। তবে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মধ্যে বিরোধ নেই। সাহিত্য চলচ্চিত্রে অনূদিত হয় না, রূপান্তরিত হয়। সাহিত্যিকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচালকের অভিজ্ঞতা মিলে গেলে তা হয় মণিকাঞ্চনযোগ। নন্দিত এই নির্মাতা আরও বলেন, প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সাহিত্যের অনুবাদ করা যায় না, রূপান্তরিত হয়। আর সাহিত্য হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্ম। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের একজন পরিচালক থাকলে অসংখ্য মানুষের শৈল্পিক সহযোগিতার অবদান হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র প্রযুক্তি নির্ভর, প্রযুক্তি বদলে গেলে বদলে যায় চলচ্চিত্রের ভাষা ও প্রকৃতি। হয়তো এমন এক দিন আসবে, যেদিন সাহিত্যের ধারে কাছে আসবে না চলচ্চিত্র। একসময় সাহিত্যের সংযোগ ছাড়াই নির্মিত হবে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রে সময় ও গতি নিয়ে খেলা করা যায়, কিন্তু সাহিত্যে যায় না। সাহিত্যের মুখাপেক্ষিতা চলচ্চিত্রের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে মানজারে হাসীন মুরাদ বলেন, আখ্যান বা গল্পবলার চলচ্চিত্র যারা নির্মাণ করেন তাদের জন্য সাহিত্য হচ্ছে আকর। তবে প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের মুখাপেক্ষিতা থেকে বেরিয়ে আসতে। গল্প বলার চলচ্চিত্র আমরা আর কতদিন দেখব? তাই স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে অবশ্যই স্বাবলম্বী হতে হবে। মোনালিসা দাস বলেন, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র এক অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুটোর ভাষাই অভিব্যক্তির। তাই সাহিত্যকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্রের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি না। শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রের দুই শ বছর’ শিরোনামে দিনের শেষ সেমিনার। এতে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্নেহাশীস সুর। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন, ভারতের কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনির্বাণ চৌধুরী। আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে মুনতাসীর মামুন বলেন, বাংলা সাহিত্যের বিকাশ দুই বাংলায় একইসঙ্গে হয়েছে। বাংলা ভাষাকে শুধু ভালবাসলেই হবে না, চর্চাও করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে বলেন, গরু জবাই নিয়ে ভারতের যেমন কঠোর মনোভাব ঠিক তেমনি আমাদের মীর মশাররফ হোসেনও গরু জবাইয়ের বিপক্ষে ছিলেন। আমরা পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হতে পারিনি, তবে যত কম সাম্প্রদায়িক হওয়া যায় সে চেষ্টাই করছি। ধর্মীয় দিক থেকে আমরা ভিন্ন হলেও কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মিল রয়েছে। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা আল্পনা আঁকি, জামায়াতে ইসলামির নেতার মেয়ের বিয়েতেও আল্পনা আঁকা হয় আবার হিন্দুদের অনেক উৎসবেও আল্পনা আঁকা হয়। সংবাদপত্রের বিষয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, সর্বাধিক প্রচারিত এবং সবচেয়ে কম প্রচারিত পত্রিকার মালিকের টাকা অন্য একটি খাত থেকে আসে। সংবাদপত্রের জগতে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে। আগে সাংবাদিকদের একটা আদর্শ ছিল, কিন্তু এখনকার সাংবাদিকদের কোন আদর্শ নেই। এখন কেউ সাংবাদিক নেই এখন সবাই সংবাদ কর্মচারী। সংবাদপত্র কখনও পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে না। গ্রামীণফোন কিংবা কোন কর্পোরেট কোম্পানির বিরুদ্ধে তারা কোন সংবাদ প্রকাশ করে না। কারণ বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে। তবে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সব পত্রিকাই এক। বাংলা ভাষার বিষয়েও সব গণমাধ্যম এক ও অভিন্ন। দ্রেহের একটা বৈশিষ্ট্য তারা ধরে রেখেছে। এই ইতিহাস দুই বাংলার দৈনিকের তুলনা করে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকার তুলনায় আমাদের পত্রিকাগুলো অনেক বেটার। আমাদের কনটেন্ট অনেক বেশি। বিকেলে এই মঞ্চটি সরব হয়ে ওঠে গল্পপাঠ ও কথাসাহিত্যভিত্তিক আলোচনায়। এতে গল্পপাঠ করেন সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম, মেহেদী উল্লাহ ও খালিদ মারুফ। আলোচনা করেন আবুল বাশার, অমর মিত্র, ইমদাদুল হক মিলন, শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত ও স্বকৃত নোমান। সঞ্চালনায় ছিলেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। অনেক আকাশ তাঁবুতে ছিল ‘কথাপর্ব’ শিরোনামের আয়োজন। চারটি ভিন্ন বিষয়ে তরুণ সাহিত্যিকরা আলোচনা করেন নিজেদের কর্ম ও সমসমায়িকতা নিয়ে। ‘কবিতার ভাষা ও কবির অনন্যতা’ শিরোনামের কথাপর্বে অতিথি ছিলেন ভারতের স্বপ্নময় চক্রবর্তী। আলোচক ছিলেন আকিমুন রহমান, টোকন ঠাকুর, জাফর আহমদ রাশেদ ও ফারহান ইশরাক। সঞ্চালনায় ছিলেন সুমন রহমান। ‘প্রমিত ভাষার সীমা’ শিরোনামের কথাপর্বে আলোচনা করেন মানস চৌধুরী, চঞ্চল আশরাফ, সাখাওয়াত টিপু ও সোহেল হাসান গালিব। সঞ্চালনায় ছিলেন কুমার চক্রবর্তী। ‘দায়বদ্ধতার সাহিত্য এবং সাহিত্যের দায়বদ্ধতা’ শিরোনামের কথাপর্বে অতিথি ছিলেন অভিজিৎ সেন। আলোচক ছিলেন অদিতি ফাল্গুনী, ফারুক ওয়াসিফ, রোকসানা চৌধুরী ও দ্রাবিড় সৈকত। সঞ্চালনায় ছিলেন সঞ্জীব পুরোহিত। ‘বাংলা নাটকের আঙ্গিকসাধনা’ শিরোনামের কথাপর্বে অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নাট্যজন মনোজ মিত্র। আলোচনায় ছিলেন মাসুম রেজা, সেলিম মোজাহার, আলতাফ শাহনেওয়াজ ও শাহমান মৈশান। সঞ্চালনায় ছিলেন রুমা মোদক। বিকেলে রবীন্দ্র মঞ্চে ছিল কবিতাপাঠ ও আবহমান বাংলা গান। এই কবিতা পাঠ করেন দুই বাংলার কবি ও আবৃত্তি শিল্পীরা। এছাড়াও বিকেলে লালন চত্বরে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন দুই দেশের কণ্ঠশিল্পীরা। সন্ধ্যায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত নাটক ‘ধাবমান’। সমাপনী আয়োজন ॥ তিনদিনের আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের শেষ দিন আজ সোমবার। এদিন বিকেলে নজরুল মঞ্চে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ভারতের ঝাড়খন্ডের সাহিত্য-সংগঠক সরযূ রায়। সমাপনী বক্তব্য রাখবেন সম্মেলনের আহ্বায়ক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব শুরু ॥ চারপাশে দৃশ্যমান আবহমান বাংলার যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ। আছে শীতলপাটি থেকে শুরু করে নক্সিকাঁথা, শখের হাঁড়ি, শোলার মুখোশ, কাঁসা-পিতলের কারুশিল্পসহ নানা কিছু। সেই সঙ্গে উৎসবে যুক্ত হয়েছে বাউল গান, ভাটিয়ালি, কবিগান, পালাগান। এমনই বৈভবময় আয়োজনে রবিবার থেকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে শুরু হলো মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। জনকণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রবিবার দুপুরে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে মাসব্যাপী এ উৎসব ও মেলার উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক রবীন্দ্র গোপের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহিনূর ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিয়ার রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ্যাডভোকেট শামছুল ইসলাম ভূঁইয়া, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালাম ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ওসমান গনি প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে কারুশিল্পীদের জীবনমান উন্নয়নের উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান নূর বলে, সারাদেশের গ্রামীণ শিল্পীদের তালিকা প্রণয়নের জন্য দেশব্যাপী জরিপ করা হবে। দেশের অনেক অঞ্চলের কারুশিল্পীরা দুর্দশার মধ্যে আছেন। ঐতিহ্যবাহী এলাকা সোনারগাঁ ব্যতিক্রম নয়। এখানে কাঠের ঘোড়া, হাতি ও পুতুল তৈরির কারিগররা দুই-একটি পরিবারের মধ্য সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ওই কাজটি তারা আর করতে চান না। হাতি, ঘোড়া তৈরির পর তা বিক্রি করে তারা যে টাকা পান সেই টাকায় তারা আগ্রহী হারিয়ে ফেলেন। অথচ তারা খাট পালং ও চেয়ার-টেবিল বানালে অনেক টাকা তারা অনেক বেশি আয় করতে পারেন। অথচ এসব কাঠের হাতি, ঘোড়া, পুতুল যখন বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের হাতে তুলে দেয় তখন তারা খুব আগ্রহী হয়ে সেগুলো সংগ্রহ করেন। আশার বারতা দিয়ে তিনি বলেন, গ্রামীণ শিল্পীদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি আমরা তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে হয়ত তারা আবারও সেই কাজে ফিরে আসবেন। সোনারগাঁ অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার কথা উল্লেখ করে সংস্কৃতি বলেন, পানাম নগরীতে ৫২টি ভবন আছে। প্রতœ ইতিহাসের সাক্ষী কারুকার্যখচিত এই ভবনগুলো সংস্কারের মাধ্যমে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এটা হলে পানাম নগরীতে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা আসবেন। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিও মাধ্যমে সোনারগাঁ অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। মেলার পণ্যসম্ভার : বাংলাদেশের নানা প্রান্তের ৬০ কারুশিল্পী অংশ নিচ্ছেন এ মেলায়। তাদের জন্য ফ্রি ৩০টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলাশিল্প, রাজশাহীর শখের হাড়ি, চট্টগ্রামের নকশী পাখা, রংপুরের শতরঞ্জি, সোনারগাঁয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, নক্সিকাঁথা, মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি, মানিকগঞ্জের তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তৈরি কারুপণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্প, সোনারগাঁয়ের পাটের কারুশিল্প, নাটোরের শোলার মুখোশ শিল্প, মুন্সীগঞ্জের পটচিত্র, ঢাকার কাগজের হস্তশিল্পসহ মোট ১৮০টি স্টল ঠাঁই পেয়েছে লোকজ মেলায়। এই ১৮০টি স্টলের মধ্যে হস্তশিল্প ৪৫টি, পোশাক শিল্প ৪৫টি, স্টেশনারি ও কসমেটিক্স ৩৪টি, খাবার স্টল ১৬টি, মিষ্টির ১০টি ও ৩০টি স্টল কারুশিল্পের কারুপণ্য উৎপাদন প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন বিকেলে মেলা মঞ্চে বাউলগান, পালাগান, কবিগান, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান, জারি-সারি ও হাছন রাজার গান, লালন সঙ্গীত, মাইজভান্ডারী গান, মুর্শিদী গান, আলকাপ গান, গাঁয়ে হলুদের গান, বান্দরবান, বিরিশিরি, কমলগঞ্জের-মণিপুরী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শরিয়ত-মারফতি গান, ছড়াপাঠের আসর ও পুঁথিপাঠ অনুষ্ঠিত হবে। সেই সঙ্গে থাকবে লাঠি খেলা, দোক খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, লোকজ জীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্পবলার। মেলা আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
×