ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর

অভিমত ॥ বাজার স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ বাজার স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন

কখনও কখনও কোন কোন কৃষিপণ্য কৃষক এবং সাধারণ মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সম্প্রতি তেমনি দুটি কৃষিপণ্য সারা দেশের মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে। তার একটি আলু এবং আরেকটি পেঁয়াজ। আলু সবকিছুতেই লাগে এবং পেঁয়াজ আলুর তুলনায় কম লাগলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য। আলু বেশিরভাগ সময়ই সবজির বিকল্প হিসেবে খেতে হয়। অপরদিকে পেঁয়াজ মসলা হিসেবে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য মূল্যের দিক দিয়ে একে অপরের বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। আলু পেঁয়াজের এমন বিপরীতমূখী সম্পর্ক আমাদের মানুষের জন্য, অর্থনীতির জন্য, সরকারের জন্য এমনকি সার্বিকভাবে দেশের জন্য কোন রকমেই ভাল নয়। গত এক বছর ধরে বাজারে আলুর দামের ক্রমহ্রাসমান হয়ে খুব খারাপ অবস্থায় যাচ্ছে। অপরদিকে বিগত প্রায় ৩-৪ মাস ধরে পেঁয়াজের দামের ক্রমবর্ধমান অবস্থা সকল আয়ের মানুষকে তাদের পারিবারিক বাজেটকে এক হাত ক্ষতির সম্মুখীন করে দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশের কৃষির অবস্থার সঙ্গে তা কোনটিই স্বাভাবিক নয়। কারণ দেশের বেশিরভাগ এলাকাতেই আলু এবং পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। এ দুটি একই ঋতু অর্থাৎ রবি মৌসুমের ফসল। সারাদেশে প্রতিবছর আলু এখন এতবেশি পরিমাণে ফলছে যে চাহিদা এবং যোগানের বেড়াজালে পড়ে সেটার দাম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অথচ আমরা জানি আলু একটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- যে পরিমাণ আলু আমাদের বর্তমানে দৈনন্দিন চাহিদায় প্রয়োজন, তার থেকে অনেক বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও চাহিদার অতিরিক্ত পরিমাণ বিদেশে রফতানি করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। পচনশীল একটি পণ্য হওয়ায় অনেক আলু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক বিপরীত হলো পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। প্রতিবছর আমাদের যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার কথা তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ আমাদের চাহিদা। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদিত পেঁয়াজে আমাদের সারা বছরের সারাদেশের চাহিদা না মেটাতে পারার কারণে প্রতিবছরই আমাদের পেঁয়াজের আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হয়। দেখা গেছে স্বাভাবিক সময়ে এগুলোর দাম কিছুটা নাগালে থাকলেও অফ মৌসুমে দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে নাগরিক ভোগান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন এখন আলুর কথা ধরলে মৌসুমে নতুন আলুর দাম কেজিপ্রতি জাত ভেদে ২০ থেকে ৪০ টাকা হলেও ঠিক একই সময়ে পুরাতন আলু একেবারে নামেমাত্র মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তাও আবার অনেকে তা আর সহজে কিনতে চায় না। অপরদিকে মাত্র এক মাস আগেও যে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি এক শ’ টাকার ওপরে ছিল এখন তা মৌসুমের ভেতর জাত ভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে পত্রিকায় এমন খবরও উঠতে দেখেছি যে, এক মণ আলু দিয়ে মাত্র আধা কেজি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে। তার মানে হলো- তখন প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য যদি ১২০ টাকা হয়ে থাকে তখন এক মণ আলুর মূল্য ছিল মাত্র ৬০ টাকা যা খুবই অনৈতিক ও অস্বাভাবিক। এমন একটি অবস্থায় একজন কৃষক স্বাভাবিকভাবেই আলু উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাতে আবার পরের বছর সমস্যা সৃষ্টি হবে নিশ্চিতভাবেই। কারণ ব্যবসার একটি সাধারণ নীতি রয়েছে। যে বছর কৃষক কোন পণ্যের আবাদ করে তার সেই উৎপাদিত পণ্যের ভাল মূল্য পায়, তখন পরের বছর এর আবাদও বেড়ে যায়। অপরদিকে কোন বছর কোন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য কম থাকলে পরের বছর কৃষক আর সেটি তেমনভাবে উৎপাদনে আগ্রহ দেখায় না। সেজন্য স্বাভাবিক কারণে পরের বছর সেই পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। এগুলোকে কখনও কখনও বড় ধরনের সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়। সেজন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বাভাস। আর আলুর মূল্যবৃদ্ধি করতে হলে উৎপাদন কমিয়ে নয়, বাড়াতে হবে এর বৈদেশিক রফতানি এবং বাড়াতে হবে বহুমুখী ব্যবহার। তাছাড়া আলু শর্করা খাদ্য উৎপাদনের একটি অন্যতম প্রধান উৎস বিধায় ভাতের পরিবর্তে আলু খেতে হবে। অপরদিকে পেঁয়াজের আবাদ আরও ব্যাপকতর করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের কৃষি পরিবেশের যেসব ব্যবস্থায় আলু উৎপাদিত হয়, ঠিক একই অবস্থায় পেঁয়াজও উৎপাদিত হয়। সেজন্য প্রতিবছর বিশেষ বিশেষ সময়ে অর্থাৎ রমজান মাসে অথবা অফ মৌসুমে পেঁয়াজের মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে পেঁয়াজের আবাদ বাড়ালে সঠিক সময়ে দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ নিশ্চিত হবে। কাজেই আমাদের দেশের দুটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও মূল্যের ওপর সরকারও অনেক সময় বিপাকে পড়ে যায়। অথচ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের একটু সচেতনতা এবং পূর্ব পরিকল্পনা এ থেকে অতি সহজেই পরিত্রাণ দিতে পারে। যে বছর দেখা যাবে কোন কারণে পেঁয়াজের উৎপাদনে কিছুটা পেছনে পড়ে গেছে। সে বছর আগে থেকেই পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার যে বছর দেখা যাবে আলুর উৎপাদন বেড়ে গেছে অর্থাৎ ফলনে বাম্পার হয়েছে, সে বছর আগে থেকেই আলু রফতানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবেই এ ফসলগুলোর ব্যাপারে পূর্বাভাস ও সতর্কতা গ্রহণ করলে সুফল পাওয়া যাবে। দেশের সচেতন ব্যক্তি, কৃষি বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ আরও তদসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এতে সহযোগিতা দিতে পারে। আর এতে দেশ-জাতি সকলেই উপকৃত হবেন। লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×