ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি -জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

বিএনপি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি -জাফর ওয়াজেদ

সামান্য অসুখেও মানুষ তড়পায়। আর দুরারোগ্য ব্যাধি হলে তো উন্মাদনা বাড়ে, অস্থিরতা-অসহিষ্ণুতা নতুন মাত্রা পায়। এমনই অবস্থা আজ জাতীয়তাবাদী নামধারী দল বিএনপির। অসুখে-বিসুখে এমনই ধরাশায়ী হাল তার। কোন বদ্যি, কবিরাজেও হচ্ছে না কাজ। হোমিওপ্যাথ, এলোপ্যাথও সারাতে পারছে না এই রোগ। রোগাক্রান্ত দেহে তাই অক্ষমের আর্তনাদই শুনিয়ে যায়। তাই তার মুখনিঃসৃত হয়ে উঠে আসে প্রলাপ। যখন যা মুখে আসে, তাই ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। আর তাতে ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত বাক্যগুলো। এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের কোন পথ বা পন্থা তারা পায় না, পাওয়ার চেষ্টাও নেই। বাংলাদেশের মানুষ যতই সহিষ্ণু হোক, বিএনপি নামক দলটি ততো বেশিই অসহিষ্ণু। অবশ্য তাদের অতীত ইতিবৃত্তই হচ্ছে অসহিষ্ণুতাপূর্ণ। এই দেশে আমাদের শৈশবে, সেই ষাটের দশক থেকে পঁচাত্তরের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দেখে এসেছি- মুসলমান হিন্দুকে, হিন্দু মুসলমানকে, বাঙালী অবাঙালীকে, গরিব বড় লোককে এবং নারী পুরুষকে সহ্য করে। পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সমঝোতা, সদ্ভাব, সহিষ্ণুতা, সৌহার্দ, সম্প্রীতি গভীরভাবে মিশে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরবর্তী দুই সামরিক জান্তা শাসক এবং তাদের উত্তরসূরিরা এতোই অসহিষ্ণু ছিলেন যে, তারা ধর্মকে বর্ম বানিয়ে মানুষের মধ্যে ধর্মান্ধতার বিস্তার শুধু নয়, রাজনীতিতে ধর্মের হীন অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও অপর ধর্মকে হেয় করার চেষ্টা ছড়িয়েছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাজারে নামিয়ে দিয়ে অধর্মের যতো কাজ আছে, সবই করে আসছে। সাম্প্রতিক চিন্তাকে হয়তো মনে হবে সাধারণ। এরকম মেজাজে গণতন্ত্রের একটাই পরিণাম, একটি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানেই অন্য সমাজের বিনাশ। ধর্মের বেলায়ও যা খাটে। ঠিক যেমন আধুনিক রাষ্ট্রের একটা সর্বগ্রাসী চেহারা রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের, তেমনি সংখ্যালঘুদেরও। এই দু’য়ের সংমিশ্রণ ক্ষতিকর নয়, বরং লাভজনক সবার জন্য। এই যে বিএনপি ও তার নেত্রী প্রায়শ চিৎকার করে, দেশের মানুষের স্বাধীনতা আজ বিপন্ন। গণতন্ত্র গতায়ু। মানুষ অভাবে আছে। কথা বলা যায় না- ইত্যাকার যাবতীয় গীবত ও পরনিন্দা-পরচর্চায় মাতোয়ারা। আর এসবই তাকে অসুস্থ করে তুলেছে। এই অবস্থা থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করে সার্বিক উত্তরণ ঘটানোর কাজটি সহজ নয়। শেখ হাসিনার কাছে জাতি কৃতজ্ঞ। পচা-গলা, দুর্নীতি আর লুটেরা সমাজের যে সৃষ্টি তা বিএনপি করেছে। সেই অসুস্থ অবদান অপহরণ করে তিনি দেশ ও দেশবাসীকে সজাগ করেছেন। বিএনপি যে সময়কাল থেকে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে তখন থেকেই পশ্চাৎপদতা এসে বাসা বেঁধেছে। জ্ঞানচর্চার শিক্ষা এবং চরিত্র গঠনের শিক্ষা বিএনপিকে আকর্ষণ করেনি বলেই তারা অশিক্ষা-কুশিক্ষা চালু করেছিল। জ্ঞানচর্চার শিক্ষায় বিদ্যালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অসুস্থ দলের অসুস্থ নেত্রী বিদ্যালয়ের গ-ি পার হতে পারেননি। তাই জ্ঞানচর্চাকে তিনি দূরে ঠেলে দিয়েছেন। চরিত্র গঠনের প্রথম প্রয়োজন সুস্থ পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক পরিবেশ। চরিত্র গঠনের ব্যাপারে শিশু কোনদিন শুনে শেখে না, শিশু দেখে শেখে। বয়স্কদের বক্তব্য এবং বয়স্কদের ব্যবহার পরস্পরবিরোধী হলে শিশুমনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যে বিশৃঙ্খলা বিপজ্জনক। মানুষের মনে বিশৃঙ্খলা গভীর অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। কোন মানুষের মন যদি বিপরীত চাপে বিশৃঙ্খল হয় তাহলে সেই মানুষহত্যাকারী হয়ে উঠতে পারে। সে হত্যার আপাতদৃষ্টিতে কোন কারণ নেই। কারণ রয়েছে হত্যাকারী মনের ইতিহাসে। পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যার মধ্যে বিএনপি নিজে হত্যাকারীর অভিধায় ঠাঁই পেয়েছে। কোন কারণ ছাড়াই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বিএনপির ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মানুষগুলো মনের বিশৃঙ্খলায় এমনভাবে আক্রান্ত যে, তারা নৈরাজ্য, নাশকতা, সহিংসতাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছে। এসব বিশৃঙ্খল আচরণই তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। অবশ্য মনের গভীরে বৈপরীত্য এদেশে নতুন নয়। একাত্তর সালে এই স্ববিরোধীদের দেখা মিলেছে। পরবর্তী সময়েও যারা ধ্বংসের গর্জনে মাতোয়ারা হয়েছে। আধুনিকতার যুক্তি বিএনপি নামক উপজাতিদের মনে আজ পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। সাবেকী যুক্তি সর্বত্রই প্রবল তাদের। তাই সাবমেরিন কেবল নিখরচায় বসাতে দেয়নি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আধুনিক যুক্তিকে ধারণ করেছে বলেই দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার কাজটি সুচারুরূপে করে আসছে। মাঝেমধ্যে এদিকে-ওদিকে শোনা যায়, সুশীল নামধারীদের মুখে যে, বিএনপিতে কিছু ভাল লোক আছে। আখ্যাটা ভাল হলেও দৈনন্দিন ব্যবহারে বেশ ফ্যাকাশে। মন্দ টাকা যেমন বাজার থেকে ভাল টাকাকে সরিয়ে দিতে চায়, তেমনি মন্দ লোকের সংস্পর্শে বিএনপির কথিত ভালদের ভালত্ব বহু আগে ঘুঁচে গেছে। অবশ্য ভালমানুষ কথাটা একার্থে প্রচ্ছন্ন নিন্দা-ই। যা দিয়ে ভাল লোকদের মধ্যে রকমফের করা হয়। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না, কাউকে চাকরিচ্যুত করবে না বলে এ দলের নেত্রী যে ঘোষণা দিয়েছিলেন; তা যে অন্তঃসারশূন্য, তার পরবর্তী সময়ের ভাষ্যে স্পষ্ট হয়। বিদেশী কূটনীতিদকদের এতোই আপন মনে হয় এবং তা বড় ভাইয়ের মতো, তাই কথায় কথায় নালিশ জানাতে ছুটে যায়। এসবই অসুস্থতার লক্ষণ। বিএনপির এক নেতার মতে, বিএনপি মনে করে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রভাবশালী দেশ বা জাতিসংঘ কী চায়, সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসবই যে পাগলের প্রলাপ হয়ে ভেসে ওঠে, তা তারাও জানে। বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, নির্বাচন কোন পন্থায় হবে, সেসব নির্ধারণ করবে দেশবাসী। বিদেশীদের প্রভু মনে করে অবনত মস্তকে করুণা প্রার্থনা কোন সুস্থতার লক্ষণ নয়। যে প্রতিহিংসার রাজনীতি জিয়া, খালেদা চর্চা করে এসেছে, তা মজ্জাগত দলটির। ২০০১ সাল থেকে প্রতিহিংসার যে ধারা চালু করেছে, সেই হিংসায় নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ এক পরিবেশে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে ২০০১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ ছাড়িয়ে নৃশংসতার নৃশংস উদাহরণ রেখে যাবে। বিশ শতকের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ভোটে জিতলেন হিটলার। একমাস যেতে না যেতেই রাইখস্ট্যাগে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে শুরু করে দেন ‘হেট ক্যাম্পেন’। সমস্ত অপকর্মের জন্য দায়ী কমিউনিস্টরাÑএটাই ছিল প্রচারের মূলসুর। এর পাশাপাশি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার জন্য সংসদে পাস করিয়ে নেন ‘এ্যানেব্লিং এ্যাক্ট’। সেই সময় জার্মানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন হিন্ডেন বার্গ। তিনি হিটলারের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কাজে কোন রকম বাধাই দিলেন না। হিটলার বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। ১৯৩৪ সালে হিন্ডেন মারা গেলে হিটলার প্রেসিডেন্ট পদ অধিকার করে নেন। তখন তিনি একাধারে প্রেসিডেন্ট ও চ্যালেন্সর। জার্মানির সমস্ত ক্ষমতা তখন তার হাতের মুঠোয়। সংসদে বিরোধীরা মুখ খোলার সুযোগ পেতেন না। খুন, হামলা, মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের চুপ করিয়ে রাখা হতো। (খালেদা যেমন ‘চুপ বেয়াদব’ বলতেন)। হিটলারি শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মিথ্যাচার আর প্রতারণা। হিটলার যখন যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে, তখনও তার মুখে শান্তির বাণী। হিটলার যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাতে প্রাণ গিয়েছিল পাঁচ কোটি মানুষের। দেশ-বিদেশে এই বর্বর হিটলারের চররা আজও বিদ্যমান রয়েছে। বিএনপি অবকাঠামোগত ও মানসিকতায় হিটলারের আদর্শকেই অনুসরণ করে আসছে। তাই তারা অবলীলায় মানুষ হত্যা করতে পিছপা হয় না। জনসমর্থন আদায়ে ধর্মকে ব্যবহার করার ভ- কৌশল তাদের পুরনো হয়ে গেছে। দেশ বিক্রির গল্প আর বিক্রি হয় না। হিটলারের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, তার শিক্ষাদীক্ষা তেমন ছিল না। তিনি যাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, তারা ছিল নিম্নস্তরের মানুষ। অধিকাংশই সমাজবিরোধী নয়তো নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ, যাদের বিবেক বা রুচিবোধ বলতে কিছুই ছিল না। সেই পথ ধরেই বিএনপি নেত্রী এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। চোরাচালানি, গোরখোদক, চাকর-বাকর পর্যায়ের লোকরাই তার সাথী। শিক্ষাদীক্ষা তো দূর অস্ত। এদের তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যও ব্যবহার করেছেন। সমাজে মাদকদ্রব্যের এমনই প্রসার ঘটিয়েছিলেন যে, রক্তের ধনও মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত হয়ে অল্পবয়সেই মারা যায়। তার বড়পুত্রও শিক্ষাদীক্ষাহীন অবস্থায় চোরাচালানি, দুর্নীতি, লুটপাট আর রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহারে এমনই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, প্রায় দশ বছর ধরে দেশে ফিরতে পারছে না আর। ‘অপারেশন ক্লিনহাট’ চালু করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দিয়েছিলেন হিটলারের স্টাইলে। আবারও ক্ষমতায় যেতে পারলে গেস্টাপো কায়দায় শিক্ষিত, পেশাজীবী, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের উঠিয়ে নিয়ে খরচের তালিকায় রেখে দেবেন। নিষ্ঠুর এবং বর্বর হিটলারের জুতো পায়ে নিয়ে বিএনপি নেত্রী ছক কষছেন আবারও ক্ষমতায় আসার। আর, এবার যদি তিনি সেই সুযোগ হাসিল করতে পারেন নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, তবে দেশ জুড়ে যে একাত্তরের স্টাইলে বধ্যভূমি গড়ে তুলবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? বিএনপির মনে বিষ আছে। সেই বিষ সাপের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তা সমাজ দেহে প্রবেশ করাতে চায়। কিন্তু তারা নিজেরাই বিষাক্রান্ত হয়ে এখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। বিএনপির মধ্যে যে বিকার পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার মূলোৎপাটন করা জরুরী। তারা যেন সমাজ ও রাষ্ট্রকে যাতে আর কলুষিত করতে না পারে, সেজন্য বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়া জরুরী। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নৈরাজ্য, অরাজকতার ছক যতই কাটুক, ব্যাধি আক্রান্ত দলটি আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, ভরসা সেখানেই।
×