ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সম্ভাবনার ২০১৮

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

সম্ভাবনার ২০১৮

২০১৭ সালের পুরো বছরটা ছিল ঘটনাবহুল, ঐতিহাসিক এবং অনেক চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার এক বিচিত্র কর্মপ্রবাহের নানা সম্মিলন। ব্যর্থতা, হারানো আর অপ্রাপ্তির হরেক রকম সমীকরণে অর্জনের পাল্লাটাও ছিল বেশ ভারি। রাজনৈতিক সহিংসতার উন্মত্ততা তেমনভাবে প্রতীয়মান না হলেও অনেক বিপরীত ঘটনাস্রোত মাঝে মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বল প্রয়োগে সামান্য কারণে অত্যাচার আর নিপীড়নের মাত্রাও জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে, যা পুরো দেশবাসীকে হতবাক আর শিহরিত করেছে। যদিও এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাপ্রবাহ বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারেনি। অর্থাৎ উন্নয়নের গতিধারায় দেশ একটি বিশিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। তবে যেসব সমস্যা আর সঙ্কট ২০১৭ বছরের কাল পর্বটিতে অশনি সঙ্কেতের ছায়া ফেলেছে তার রেশ ২০১৮ সালে কত দূর গড়াবে সেটাই ভাবার বিষয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যার ভারে বাংলাদেশ বর্তমানে এক মহাসঙ্কটের মুখোমুখি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই সঙ্কট উত্তরণের কোন সুনিশ্চিত পদক্ষেপের কার্যক্রম এখন অবধি শুরু হয়নি। নামেমাত্র শুরু হলেও তা কতখানি ফলপ্রসূ হতে পারে তা কেউই বলতে পারে না। রোহিঙ্গা সঙ্কটে দিশেহারা না হয়ে প্রধানমন্ত্রী যে ধীর, স্থির আর ঠা-া মাথায় তা মোকাবেলা করছেন দেশে-বিদেশে যা বিভিন্নভাবে নন্দিত আর প্রশংসিতও হয়েছে। মানবতার জননী হিসেবে তাকে সম্মানে অভিষিক্তও করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এটা যেমন প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বড় অর্জন, একইভাবে সারাদেশের প্রেক্ষাপটেও এ এক অসামান্য অর্জন। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়াও এক অভাবনীয় প্রাপ্তি। ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ বক্তৃতাকে বৈশ্বিক মর্যাদায় আসীন করেছে। ২০১৭ সালের ঘটনাবহুল যাত্রায় আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাপ্তির চাইতে অঙ্গনটিকে নানা মাত্রিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো এক অনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়া, যা অতীতে কারো কল্পনায়ও আসেনি। শিক্ষা জাতির মেরুদ- আর শিক্ষক হলেন অভিভাবক। সে ব্যবস্থায় যদি এমনতর ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে তাহলে নতুন কিংবা ভবিষ্যত প্রজন্ম কিভাবে নিজেদের গড়ে তুলে দেশের নেতৃত্ব দেবে? এ দায় তো শুধু মন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরই নয়, এর দায়ভার নিতে হবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মহৎ প্রতিষ্ঠানে এমন অশুভ পদচারণা এক কিংবা একাধিক ব্যক্তির পক্ষে তো সম্ভবই নয়। তাই শিক্ষাকার্যক্রম ২০১৮ সালে সুন্দর গতিতে যেন এগিয়ে যেতে পারে সে বিষয়টিও গুরুত্বের সহিত ভেবে দেখা দরকার। গত বছরে নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক প্ররিবেশকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। চট্টগ্রামে পাহাড় ধস থেকে শুরু করে সারাদেশে অতিবর্ষণের পর সর্বগ্রাসী বন্যার কবলেও আক্রান্ত হয়েছে অসহায় এবং বিপর্যস্ত মানুষ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উর্ধগতি। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে ভাঙ্গা-গড়ার আবর্তে সতত ধাবিত হয় এটা যেমন সত্যি, বিপরীতভাবে মানুষের কিছু বৈরী কার্যকলাপ পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় মানুষের আয়ত্বাধীন সমস্ত কার্যকলাপের সীমারেখা নির্দিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতির অবারিত দানের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ যেমন সহ্য করা হয় না, একইভাবে মানুষকেও তার হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার সমস্ত অপকৌশল থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। আসলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোন একটি নির্দিষ্ট বছরে আটকে থাকে না। সে তার খেয়াল খুশি মতো চারপাশের পরিবেশকে নিজের মতো করে তৈরি করতে থাকে। পারিপার্শ্বিক মানুষদেরও সেই ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় সতর্কাবস্থায় থেকে নিজের ওপর যেটুকু দায় তার সবটাই যথাযথভাবে পালন করা বিশেষ জরুরী। অনিয়মিত এবং অপরিকল্পিত পাহাড় নিধন বন্ধ করে পরিবেশ সহায়ক কর্মপদ্ধতি নতুন করে ভাবনায় এনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ বিবেচনায় আনা সময়ের দাবি। সবটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও কিছুটা যদি পরিবেশ পরিস্থিতিকে সংহত করা হয়, সেই দিকটাও সবাইকে ভাবতে হবে। অনেক দুর্যোগপূর্ণ সময়কে সামলে নিয়ে বাংলাদেশ সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে গেছে যা নতুন বছরকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলতে পারে এবং যা দেশের প্রবৃদ্ধিতেও নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। উন্নয়নের নিরন্তর কর্মপ্রবাহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্বসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নারী-পুরুষের বৈষম্যের হার শুধু কমেইনি বরং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষস্থানে। ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশকে অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক মানদ-ে এসব অর্জনও কম কথা নয়। আবার অর্থনীতিতে ধস নামার উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৭ সালে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ পাচার গত বছরে সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত বিষয় ছিল। অন্যান্য ব্যাংক লুণ্ঠিত হওয়ার ঘটনাও কম হয়নি। ঋণ খেলাপীর সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনীতির মূল জায়গায় এসব ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী যা ২০১৮ সালকেও অতিক্রম করে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ তার সমূহ বিপর্যয়কে সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে কখনও পিছপা হয়নি। সেই ভাবনায় ২০১৮ সাল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে আরও প্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা, সচেতনতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সততা এবং কর্মদক্ষতা দেশের সমস্ত অশনিসঙ্কেত দূর করে মঙ্গলের বার্তা নিয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা করা মোটেও অমূলক নয় । ২০১৭ সালে জঙ্গীবাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সফল অভিযানে কতিপয় আস্তানা চিহ্নিত করে তা উচ্ছেদ করা দেশের একটি সম্ভাবনাময় প্রাপ্তি। এই ধরনের সশস্ত্র উগ্রবাদী উন্মাদনা আমরা এই নতুন বছরে আর দেখতে চাই না, এটাই সকলের প্রত্যাশা। অনেক প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি আর হারানোর বেদনায় দেশের পুরো অঙ্গন আলোড়িত হলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। কোন ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা কিংবা বীভৎসতা সেভাবে প্রতীয়মান হয়নি। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মেয়র নির্বাচিত হন কোন সংঘর্ষ ছাড়াই। ২০১৮ সালের বছর তো নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করার গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পুরো ঝড়-ঝাপটা কিংবা দায় ভার এসে পড়বে চলতি বছরের শুরু থেকেই। সুতরাং এই বছরে রাজনৈতিক পরিবেশ কতখানি স্থির আর ঠা-া থাকবে তা শুধুই সময়ের অপেক্ষায়। প্রতিপক্ষ হিসেবে শুধু বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যেই লড়াই হবে না, প্রস্তুতি চলবে নিজ দলের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের। যা চলমান রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তাল আর উত্তেজক করে তুলতে পারে। কোন সহিংসতা ছাড়া কোন নির্বাচন সেভাবে হওয়ার নজির এখন অবধি দৃশ্যমান হয়নি। ২০১৮ সাল কি আসলে ব্যতিক্রম এবং অন্য ধারার কিছু সূচনা করতে পারে? দেখা যাক সময়ের মিছিলে কে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গক্রমে আবারও এসে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা। যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট। এই মহাদুর্যোগ থেকে বের হয়ে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লের বাংলাদেশে এই রোহিঙ্গা অধিবাসীদের যে অনুপ্রবেশ তা প্রায় ৯ লাখেরও অধিক হবে এমনটাই বলা হচ্ছে। যথাযথ অবস্থানে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিতে না পারলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে যুগান্তকারী। অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটেও এসব অভিবাসী বাংলাদেশকে হরেক রকম দুর্ভোগের শিকার করছে। আর ভিনদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক বলয়ও তো অন্য মাত্রার। এমন দুরূহ ঘূর্ণাবর্ত থেকে দেশকে অচিরেই বেরিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প কোন পথ সামনে নেই। নিজ দেশের অধিবাসীদের মাতৃভূমিতে পুনর্বাসন করার সিংহভাগ দায়-দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। স্বদেশের ভূমিতে সমস্ত অধিকার নিয়ে ফিরে যাওয়ার মতো তেমন কোন নিরাপদ অবস্থা তৈরি হয়েছে কিনা সেটা এখনও দৃশ্যমান নয় রোহিঙ্গাদের। কিন্তু ভিটাচ্যুত, দেশত্যাগে বাধ্য রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে আসা বন্ধ করেনি। যদিও এখন তাদের সংখ্যা অল্প। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশে অনেক চড়াই-উৎরাই, বাধাবিপত্তির ধারা বহমান থাকা সত্ত্বেও সমৃদ্ধির জোয়ার আসতেও বেশি সময় নিচ্ছে না। সব ধরনের সঙ্কট, বিপর্যয় এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহকে সামাল দিয়েও বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্নের দরজায় নিরন্তর এগিয়ে যাবে- ২০১৮ সাল হোক সেই দীপ্ত অহঙ্কারের অঙ্গীকার। লেখক : সাংবাদিক
×