ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাজারে নকল প্রযুক্তি পণ্যের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

বাজারে নকল প্রযুক্তি পণ্যের ছড়াছড়ি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নকল প্রযুক্তি পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে। আসল পণ্যের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য না থাকায় ক্রেতার পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল যে, তিনি নকল পণ্য কিনছেন। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই টের পান, তার কেনা পণ্যটি আসল নয়। পণ্যটির ব্যবহারে কম্পিউটার ধীর গতির হয়ে যাওয়া, ব্যবহার স্মুদ না হওয়া, অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া, মাত্র ২-৩ মাস পরই পণ্যটি সঠিকভাবে কাজ না করা, ডেটা নষ্ট হয়ে যাওয়া, বা নষ্ট ডেটা উদ্ধার না হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। জানা গেছে, নকল প্রযুক্তি পণ্য দেশে ও বিদেশে দুই জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে। রাজধানী কেন্দ্রিক কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ী আছেন, যারা চীন বা হংকং থেকে সংশ্লিষ্ট ডিভাইস কিনে এনে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লোগো বসিয়ে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের প্রযুক্তি বাজার, হাতিরপুলের মোতালিব প্লাজা এবং গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী গ্রুপ এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ব্র্যান্ড পণ্যের পরিবেশকরা এসব জানলেও তাদের কিছুই করার থাকে না। তারা বলছেন, আমরা সক্রিয় হলে কিছুদিন এসব বন্ধ থাকে। আমরা ব্যবসায়ে মনোযোগ দিলে, তারা আবারও প্রবল বিক্রমে বাজারে ফিরে এসে নকল পণ্য বিক্রি করতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নকল প্রযুক্তি পণ্য চেনার কিছু উপায় রয়েছে। পণ্যের লোগো বা মনোগ্রাম, হলোগ্রাম স্টিকার দেখা, পার্ট নম্বর খুঁজে বের করা, নতুন কেনা পণ্যটি মসৃণ বা স্মুথ কিনা এসব ভালভাবে খেয়াল করলেও কিছু কিছু নকল পণ্য চেনা সম্ভব। এমনকি কোনও পণ্য কেনার আগে একাধিক দোকান যাচাই করা। অনুমোদিত পরিবেশককে খুঁজে বের করে সেখান থেকে পণ্যের দাম যাচাই করেও আসল-নকল চেনা সম্ভব বলে ব্যবসায়ীরা জানান। তারা আরও জানান, ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে নকল পণ্য বিক্রি করা সহজ। ঢাকার ক্রেতারা সচেতন হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও মফস্বলের বাজারকে এ কাজের জন্য বেছে নেয়। আর এভাবেই প্রযুক্তি বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে নকল মেমোরি কার্ড, এসডি কার্ড, কি-বোর্ড, মাউস, এক্সটার্নাল স্পীকার, র‌্যাম, পেনড্রাইভ ইত্যাদি। জানা গেছে, হার্ডডিস্ক ও মাদারবোর্ড নকল করা না গেলেও বাজারে এখন ১০-১৫ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানির হার্ডডিস্কও পাওয়া যাচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা এসব হার্ডডিস্ক না কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন। স্যামসাং এসডি ও মাইক্রো এসডি ছাড়া কোনও মেমোরি কার্ড উৎপাদন করলেও, তা বাংলাদেশে আমদানির জন্য অনুমোদিত কোনও পরিবেশক নেই। অথচ স্যামসাংয়ের নাম ব্যবহার করে দেশে বিক্রি হচ্ছে মেমোরি কার্ড। স্যামসাংয়ের লোগোযুক্ত প্যাকেট দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এগুলো স্যামসাংয়ের আসল না নকল মেমোরি কার্ড। স্যামসাংয়ের ঢাকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্যামসাং যে এসডি ও মাইক্রো এসডি কার্ড তৈরি করে, তা বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হয় না। ফলে তা পাওয়ারও কথা নয়। স্যামসাংয়ের নাম ভাঙিয়ে নকল এসব কার্ড অসাধু ব্যবসায়ীরা তৈরি করে বাজারজাত করছে। নিম্নমানের এসব কার্ড দামেও সস্তা। স্যামসাং বাংলাদেশ অফিস সূত্রে জানা গেছে, স্যামসাং বাংলাদেশের জন্য কোনও মেমোরি কার্ড তৈরি করে না। দেশের পেনড্রাইভ বাজারের ৪৫-৫০ ভাগ শেয়ার ট্রান্সসেন্ড ব্র্যান্ডের। এই ব্র্যান্ডের পেনড্রাইভও নকল হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন প্রযুক্তি বাজারে। ব্যবসায়ীরা চীন থেকে ট্রান্সসেন্ডের নামে নকল পেনড্রাইভ বানিয়ে আনছে। প্যাকেট একই রকম, লোগোও এক। গত ৫-৬ বছর ধরে পেনড্রাইভ নকল হচ্ছে। নকল পেনড্রাইভে বিক্রেতারা ওয়ারেন্টি দিচ্ছে না। দিলেও তিন মাস বা ছয় মাসের জন্য দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ট্রান্সসেন্ড ব্র্যান্ডের র‌্যামের পরিবেশক ইউসিসির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী সারোয়ার মাহমুদ খান জানান, ট্রান্সসেন্ড র‌্যাম চীন থেকে কপি করে এনে দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। নকল র‌্যাম নিম্নমানের। নিম্নমানের র‌্যাম নকল চিপ ও পিসিবি বোর্ড দিয়ে তৈরি। এসবই এখন বাজার দখল করে নিচ্ছে। ট্রান্সসেন্ডের নকল পেনড্রাইভও বাজার দখল করে নিচ্ছে। জানা গেছে, টুনইমস র‌্যামও নকল হচ্ছে। গ্লোবাল ব্র্যান্ডের (এ-ডেটা র‌্যামের পরিবেশক) চেয়ারম্যান আবদুল ফাত্তাহ বলেন, ‘এ-ডেটার কপি হচ্ছে। কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের র‌্যামের আমদানিকারকদের নিরাপত্তাসূচক ট্যাগও তৈরি করে মোড়কের গায়ে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে কোনভাবেই আসল-নকল চেনার উপায় থাকছে না’। এইচপি ব্র্যান্ডের কি-বোর্ড, মাউস, স্পীকার এক্সটার্নাল ডিভিডি রাইটার নকল পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্মার্ট টেকনোলজিসের মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) মুজাহিদ আলবেরুনী সুজন বলেন, ‘এইচপি-র নকল পণ্য চেনার উপায় আছে। প্রতিটা পণ্যের গায়ে পার্ট নম্বর দেয়া আছে। ওই নম্বর এইচপি’র সাইটে গিয়ে পরীক্ষা করলে পণ্যের ছবি, উৎপাদনের তারিখসহ সব তথ্য চলে আসবে চোখের সামনে।’ তিনি আরও জানান, বিশ্বখ্যাত লজিটেক ব্র্যান্ডের মাউস, প্রেজেন্টারও নকল হচ্ছে। তিনি ক্রেতাদের আসল পণ্য চিনে, দেখে কেনার পরামর্শ দেন। অনুমোদিত পরিবেশকের কাছ থেকে কিনলে নকল পণ্য কেনার কোনও শঙ্কা থাকবে না বলে জানান তিনি। মুজাহিদ আলবেরুনী সুজন আরও বলেন, ‘নকল পণ্যের সঙ্গে আসল পণ্যের দামের অনেক পার্থক্য থাকে। নকল পণ্য দিয়ে কোন রকমে কাজ করা গেলেও তা বেশিদিন টেকসই হয় না। ওয়ারেন্টি পাওয়া যায় না। দুই-তিন মাসের মধ্যে সমস্যা ধরা পড়ে।’ তিনি জানান, নকল পণ্য বাজারে ছড়িয়ে পড়লে পণ্যটির ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে যায়, গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয়। যা প্রযুক্তি বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলে। জানা গেছে, ডেল ব্র্যান্ডের কি-বোর্ড মাউস নকল হচ্ছে। বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে নিম্নমানের কি-বোর্ড ও মাউস। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডেল বাংলাদেশের প্রধান আতিকুর রহমান বলেন, ‘নকল পণ্য পেলে আমরা রিপোর্ট করি।’ তার দাবি, নকল পণ্যের চেয়ে বাজারে গ্রে পণ্য (অবৈধ উপায়ে দেশে আনা পণ্য) বেশি। তিনি মনে করেন, গ্রাহক এখন অনেক সচেতন। আর নকল পণ্য দেখলেই বোঝা যায়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের হার্ডওয়্যার পণ্য বিক্রেতাদের সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি আলী আশফাক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। কোন অভিযোগ এলে আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেই বিষয়ে খোঁজ খবর করি।’ তবে নকল পণ্যের সংখ্যা কম বলে তিনি দাবি করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হার্ডডিস্ক নকল না হলেও অনেকদিনের পুরনো হার্ডডিস্ক বাজারে বিক্রি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যে ব্র্যান্ডের হার্ডডিস্ক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেই ব্র্যান্ডের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষেত্র বিশেষে ১০-১৫ বছর আগে বা তারও আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের অনেক পুরনো হার্ডডিস্ক, যেগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদও কয়েক বছর আগে পার হয়ে গেছে, সেগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই হার্ডডিস্কগুলো নকলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। অনেক সময় বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারে কম্পিউটারের। তারা বলেন, অনেক দিনের পুরনো এসব হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করতে পারে। ডেটা লস হতে পারে। অতিরিক্ত গরম হয়ে সিস্টেম গরম করে ফেলতে পারে। শব্দ হতে পারে, পুরো সিস্টেম ধীর গতির করে ফেলতে পারে এবং ডেটা কপি হতেও অনেক সময় নেয়। ফলে হার্ডডিস্কও কেনার সময় বর্তমানে যে তিনটি কোম্পানি হার্ডডিস্ক তৈরি করছে, তা দেখে বিবেচনা করে কেনা উচিত। বর্তমানে হার্ডডিস্ক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে- সিগেট, তোশিবা ও ডব্লিউডি (ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল)। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠানে হার্ডডিস্ক ইউনিটের কোন অস্তিত্ব নেই। জানা গেছে, হার্ডডিস্ক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিগেট ১৯৮৯ সালে সিডিসি, ১৯৯৬ সালে কোনার, ২০০৬ সালে ম্যাক্সটর (ম্যাক্সটর ২০০০ সালে কোয়ান্টাম ও ১৯৯০ সালে মিনি স্ক্রাইবকে কিনে নেয়) এবং ২০১১ সালে স্যামসাংয়ের হার্ডডিস্ক উৎপাদনকারী ইউনিটকে কিনে নেয়। অন্যদিকে, ডব্লিউডি ১৯৮৮ সালে ট্যান্ডনকে অধিগ্রহণ করে। আইবিএমকে ২০০২ সালে হিটাচি ও হিটাচির একটি অংশকে (২.৫ ইঞ্চি) ২০১১ সালে ডব্লিউডি এবং ৩.৫ ইঞ্চির ইউনিটকে ২০১২ সালে তোশিবা কিনে নেয়। এই তোশিবা আবার ২০০৯ সালে কিনে নেয় ফুজিৎসুর হার্ডডিস্ক নির্মাণকারী ইউনিটকে। তাই বর্তমানে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানই হার্ডডিস্ক তৈরি করছে।
×