ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝুঁকি- কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

অগ্নিঝুঁকি- কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা

মশিউর রহমান ॥ রাজধানীতে সরকারী-বেসরকারী স্বায়ত্তশাসিত কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা নেই ও দুই দফা কঠোর নির্দেশনা সত্ত্বেও আইন না মানায় শীঘ্রই আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর কর্তৃপক্ষ। ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণের পর নোটিস দেয়া অগ্নি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগেরও বেশি প্রতিষ্ঠানই গত প্রায় এক বছরেও কোন প্রকার সক্ষমতা অর্জনে সামান্য কাজ পর্যন্ত করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বিপনী বিতান, সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, এয়ারপোর্ট, ছোট বড় ও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী বেসরকারী ব্যাংক, ক্লিনিক, হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল এবং গণমাধ্যম কার্যালয়। অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধির নোটিস পাঠানোর পর এসব প্রতিষ্ঠান কোন প্রকার পদক্ষেপ না নেয়ায় গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আট মাসে রাজধানীতে কমপক্ষে দেড় শ’ ছোট বড় অগ্নিকা- ঘটেছে। অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই চলছে এমন শনাক্ত প্রতিষ্ঠানকে শেষবারের মতো সুযোগ হিসেবে দ্রুত নির্দেশনা মানতে চূড়ান্ত নোটিস দেয়া হবে। এরপরও কোন প্রতিষ্ঠান অগ্নিঝুঁকি নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে বলে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ফায়ার আইন-২০০৩ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সংস্থাটি। গত বছরের চার জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গুলশানের মার্কেটে আগুন লাগার পর ফেব্রুয়ারিতে দুই সিটি কর্পোরেশন ও আশপাশের জনবহুল এলাকায় অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা যাচাই করতে মাঠে নামে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। এরপর সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ শেষে তালিকা তৈরির পর গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এসব প্রতিষ্ঠানকে জনজীবন সুরক্ষায় অতি দ্রুত সক্ষমতা অর্জনের জন্য পরপর দুই দফা নোটিস দিলেও নোটিসের কোন পাত্তাই দিচ্ছে না হাজার হাজার ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। প্রায় এক বছরেও এসব প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনে কাজ করেনি যা ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। এসব স্থাপনায় যে কোন সময় আগুন লাগার বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। ২০০৩ সালের ফায়ার আইন অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে তাকে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে অপরাধী। অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী কমপক্ষে উক্ত প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে আইন অমান্যকারীকে তিন বছরের জেল ও তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সময় বা সংস্থাটির কোন কাজে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বাধা প্রদান করলে তাকে ছয় মাসের কারাদ- প্রদান করা হবে। এ ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনাকারীদের ক্ষেত্রেও একই আইন প্রযোজ্য। ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় উত্তরার একটি আবাসিক হোটেলসহ পাশাপাশি তিনটি ভবনে গত তিন জুলাই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ হোটেলটিকে প্রথম দফায় গত বছরের মার্চ মাসেই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ এতে সাড়া দেয়নি। পরে দ্বিতীয় দফা নোটিস প্রদান করে। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ তাতে কোন সাড়া দেয়নি। অগ্নিকা-ের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ইউনিট টানা পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর এসব ভবনের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় দুজন দগ্ধ হয়ে মারা যায় ও কয়েকজন আহত হয়। গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকা-ের পর ঢাকাকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ মহানগরীর সব ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়। অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা রয়েছে কি-না তা জানতে পরিদর্শনের মধ্যে মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, ভবন বা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি রয়েছে কি-না, ভবনের মেঝের আয়তন, জরুরী বহির্গমন সিঁড়ি, প্রয়োজনীয় লিফট ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হয়। পরে প্রাণহানিসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে স্থাপনাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে ‘সন্তোষজনক’ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মতামত দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার প্রায় সব হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল, বিপণি বিতান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। তালিকায় থাকা রাজধানীর মোট এক হাজার ১৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৪টিকে খুবই ঝুঁকিপুর্ণ ঘোষণা করা হয়। আর ৯২৪টিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সন্তোষজনক বলে উল্লেখ করা হয়। ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় রয়েছে আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিপ্রেস উচ্চ বিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, মাস্টার মাইন্ড স্কুল, মাইলস্টোন কলেজ, তেজগাঁও আদর্শ স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ইস্পাহানী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলসহ রাজধানীর স্বনামধন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই নয়, বিপণি বিতানগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। রাজধানীর এক হাজার ২৭৫ বিপণি বিতান পরিদর্শন শেষে ৫৪১টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ৬৮৭টিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৭ বিপণি বিতানকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে মোট ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ১৭৪টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪৮টি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকা অতি ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে শমরিতা হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার এ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, মেরিস্টোপ বাংলাদেশসহ বেশকিছু হাসপাতাল। আর অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকায় ১১ হাসপাতালকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে এ্যাপোলো, ইউনাইটেড ও স্কয়ার হাসপাতালের নাম রয়েছে। একই সময়ে রাজধানীর ৩২৫টি আবাসিক হোটেল পরিদর্শন করে ২৪৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০টিকে খুবই ঝঁকিপূর্ণ এবং সাত আবাসিক হোটেলকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীতে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের ৬৯২ শাখা অফিস পরিদর্শন শেষে ১৭৩টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ৪৭৪টিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪৫টিকে সন্তোষজনক ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি রাজধানীর মোট ২৬টি মিডিয়া সেন্টারও পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ১৮টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ছয়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং দুইটিকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় এসব প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রথম দফা নোটিস পাঠানো হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে। এরপর একমাস সময় দিয়ে এপ্রিল-মে মাসে পুনরায় ওইসব প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে গিয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে দ্বিতীয় দফা নোটিস পাঠানো হয়। কিন্তু এরপর কিছু ব্যাংকের শাখা কার্যালয়ে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলেও অন্যরা আগের মতোই রয়েছে। তবে চূড়ান্ত নোটিসের পর এসব প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে সরকারী-বেসরকারী স্বায়ত্তশাসিত এমন কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা নেই। আইন না মানায় শীঘ্রই আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। দুই দফায় সতর্ক করার পরেও অগ্নিঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঁচভাগ প্রতিষ্ঠানও নিয়মানুযায়ী তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেনি। ফায়ার সার্ভিসের পর্যবেক্ষণের পর নোটিস দেয়া অগ্নি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ এসব প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগেরও বেশি প্রতিষ্ঠানই গত এক বছরেও সক্ষমতা অর্জনে সামান্য কাজ পর্যন্ত করেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বিপণি বিতান, সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, এয়ারপোর্ট, ছোট বড় ও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল এবং গণমাধ্যম কার্যালয়। অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধির নোটিস পাঠানোর পর এসব প্রতিষ্ঠান কোন প্রকার পদক্ষেপ না নেয়ায় গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আট মাসে রাজধানীতে কমপক্ষে দেড় শ’ ছোট বড় অগ্নিকা- ঘটেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা পরিচালনাকারী ও নিয়মিত যাতায়তকারীদের জনজীবন সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে আমরা এসব প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে শেষবারের মতো তাদের কাছে একটি চূড়ান্ত নোটিস পাঠানো হবে। এতেও কেউ কর্ণপাত না করলে তাদের বিরুদ্ধে অগ্নি আইন ২০০৩ অনুযায়ী মামলা দায়ের, সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা তা করতে বাধ্য হব।
×