ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছুটির দিনে ভিড়ে ঠাসা বাণিজ্যমেলা

এবার দেশী পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণ বেশি, দামও কম

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

এবার দেশী পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের আকর্ষণ বেশি, দামও কম

ওয়াজেদ হীরা ॥ সপ্তাহের অন্য যে কোন দিনের তুলনায় ছুটির দিনে একটু বেশিই ভিড় জমে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায়। হাজারো মানুষের পদচারণায় ব্যবসায়ীদের বিকিকিনিও জমজমাট। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। আর দর্শনার্থীদের এবারের প্রথম পছন্দ দেশী পণ্য। দেশী পণ্য সুলভে পাওয়ার জন্য স্টলগুলোতে ক্রেতারা ভিড় জমিয়েছেন। শুক্রবারের চেয়ে কোন অংশেই কম যায় না শনিবারও। কেউ কেউ দুদিন ধরেই মেলায় আসেন। বিনোদন আর কেনাকাটা দুই-ই উপভোগ করেন। আর ক্রেতাদের অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বিক্রেতাদের। শনিবার সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে মেলা প্রাঙ্গণ। দুপুরের পর মানুষের সেই ¯্রােত শুধু বাড়তেই থাকে। অতিরিক্ত ভিড়ে মেলার চারপাশে একটু যানজটেরও সৃষ্টি হয়। মেলা ঘুরে দেখা গেছে, দেশী-বিদেশী হাজারও রকমের পণ্যে ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ দেশী পণ্য। বিক্রেতারাও জানিয়েছেন দেশী পণ্য নজর কেড়েছে ক্রেতাদের। এক্ষেত্রে দেশী ব্র্যান্ডের প্লাস্টিক, হোম টেক্সটাইল, জুয়েলারি, প্রসাধন সামগ্রী ও পোশাকের চাহিদা বেশি। ইলেকট্রনিক্সের মধ্যে রাইস কুকার, ওভেন, ব্লেলন্ডার ফ্রিজ, এলইডি টিভি, এসি, ডিপফ্রিজ, ফ্যান ও আয়রনসহ বিভিন্ন হোমএ্যাপ্লায়েন্স বিক্রি বেড়েছে। বিভিন্ন দেশীয় পণ্য বিক্রি বৃদ্ধিতে বেশ খুশি ব্যবসায়ীরাও। দেখা গেছে, বিদেশী পণ্যের তুলনায় দেশী পণ্যের প্যাভিলিয়ন স্টলে ভিড় বহুগুণ বেশি। মেলায় বিদেশী প্যাভিলিয়নের ভেতরে নানা দেশী পণ্য স্থান পেয়েছে। সেসব কিনতেও বেশ ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে জুয়েলারি পণ্য জুতা জামা কিনতে বেশি ভিড় করছেন নারী ক্রেতারা। দেশের তৈরি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য বার বার দেখছেন এবং পছন্দ হলে কিনে নিতেও দেখা গেছে ক্রেতাদের। দেশী বুটিক, তৈরি পোশাকের স্টলগুলো জমজমাট। তামান্না ফারিয়া হাতে তৈরি ব্যাগ কিনে বলেন, এই পণ্য একটা আলাদা ভালবাসা আছে। দামও আমাদের সাধ্যের মধ্যে। বাহারি বুনন আছে এই কাজে, বলেন তিনি। এছাড়াও মেলায় রং ছড়াচ্ছে রংপুরের শতরঞ্জি। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, যমুনা, ধরলা নদ-নদী বিধৌত এ জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতীক এই শতরঞ্জি। চিরায়ত বাংলার নয়নাভিরাম নক্সাখচিত শতরঞ্জি এক সময় সমাজের বিত্তবানদের বসতবাড়িতে, বাংলো বা অতিথিশালায় ভোজনের বিশেষ আসন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রাজধানী ঢাকাতেও এর কদর বোঝা যায় বাণিজ্যমেলার স্টলে গেলেই। বাণিজ্যমেলার এসএমই ফাউন্ডেশনের প্যাভিলিয়নে দেখা গেছে, ‘রংপুর ক্রাফ্ট’ ও ‘শতরঞ্জি পল্লী’ নামের দুটি স্টলে বিভিন্ন ডিজাইনের শতরঞ্জির পসরা বসানো হয়েছে। আর এই স্টল দুটি ঘিরে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। এছাড়াও বিভিন্ন দেশীয় ডিজাইনের টেবিলম্যাট, কুশন কভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশ, হাত ব্যাগ, সোফার কাভার, মোবাইল ব্যাগ কিনতেও ভিড় ক্রেতাদের। দেশীয় প্লাস্টিক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেঙ্গল, তানিন, আরএফএলে প্রচুর মানুষের সমাগম দেখা গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন নারীরা। গৃহস্থালি পণ্য কিনে মানসুরা হামিদ বলেন, আমাদের এই পণ্যগুলো প্রতিনিয়ত প্রয়োজন। মেলায় একটু ছাড়ে পেলাম তাই কিনে নিলাম। দেশীয় বিভিন্ন জামা স্কার্ফ, বোরখা কিনতে তরুণীদের ভিড় ছিল দেখার মতো। বিদেশী পণ্যের চেয়ে এর দাম যেমন একটু কম সেই সঙ্গে অনেক ডিজাইনের বিভিন্ন রঙের পাওয়া যায় বলেই তরুণীদের এত আগ্রহ। বিভিন্ন জুতার স্টলে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে কেভস ও বিভিন্ন ডিজাইনের স্যু। তবে ঘরে আরামদায়কভাবে পাদুকা হিসেবে স্যান্ডেলই জনপ্রিয়। বিক্রেতা আবুল কাশেম বলেন, মেলা শুরুর পর দুই দফায় পণ্য আনতে হয়েছে। বিক্রিও অনেক ভাল। তবে ছুটির দিনের চেয়ে অন্যদিনে বিক্রি একটু কমে যায়। মেলায় নকশী কাঁথাও পাওয়া যাচ্ছে। যা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী নকশী কাঁথা ছাড়াও যশোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও জামালপুর থেকে আনা হয় এসব পণ্য। হাতে তৈরি বাহারি নকশী কাঁথার মূল্য এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাতলা কাপড় থরে থরে সাজিয়ে সেলাই করে এ কাঁথা তৈরি হয়। কাপড় বোনার সুতা দিয়ে এতে নক্সা করা হয়। হাতের নৈপুণ্যে এতে বিচিত্র রঙের নক্সা, তরঙ্গ ও গল্পের প্রকাশ ঘটে। এজন্য এর নাম নকশী কাঁথা। শৌখিন নারীদের এসব কাঁথার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে। ডিজাইনের ভিন্নতা, অনেকটা জামদানি শাড়ির মতো। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবছর এর চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারো কোনটা পছন্দ হলে সঙ্গে সঙ্গেই নেয় নিচ্ছেন। পরে এলে আর একই ডিজাইনের পাওয়া যায় না। মেলায় পাটের পণ্য কিনতেও দেখা গেছে ক্রেতাদের। বিশেষ করে পাটের ব্যাগ চাহিদায় অন্যতম। মেলায় তরুণরা বিভিন্ন ব্লেজার, শার্ট, বাহারি জুতা কিংবা চামড়ার বেল্ট কিনলেও তরুণীদের পছন্দ জুয়েলারি জুতা আর জামা। জুয়েলারি কিনতে গিয়ে বিভিন্ন পাথরে তৈরি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে বিদেশী পণ্য প্রাধান্য দিলেও জামা জুতার ক্ষেত্রে দেশের পণ্যই পথম পছন্দ তরুণীদের। বাচ্চাদের বিভিন্ন আইটেমের খেলার স্টলগুলোতেও উপচে পড়া ভিড়। খোরশেদ মাহবুব আওয়াল বলেন, ছুটি থাকায় বাচ্চাদের নিয়ে মেলায় এসেছি। বাচ্চাদের পছন্দের জিনিস কিনলাম। বিভিন্ন শুষ্ক খাবারের প্যাভিলিয়নে নানা অফার লুফে নিতেও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি ছিল দেখার মতো। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিস্কুট, কেক, চকোলেট, ললিপপ, জ্যাম-জেলি, নুডলসসহ বিভিন্ন পণ্যে নানা অফার। বিভিন্ন ঝুড়িতে, বাহারি ডিজাইনের বাঁশের খাঁচায় সাজানো নানা পণ্য একত্রে রেখে ছাড়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। জানা গেছে, এসব খাবারের পণ্য বাইরে থেকে কিনতে গেলে ক্ষেত্রভেদে ৫০ থেকে আরও বেশি কমে পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মেলায় বিক্রির এই ধারাবাহিকতা থাকলে আগামী দিনগুলোতে দেশের পণ্য আরও চাহিদা বাড়বে। একই সঙ্গে দেশের পণ্যের মান পূর্বের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলেও মনে করছেন বিক্রেতারা। একাধিক ক্রেতা কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, দেশের পণ্য কিনে দেশী উৎপাদনের সঙ্গে আমরা থাকতে চাই। তবে যা কিনলাম সেটির গুণগত মানটা অবশ্যই দেখার বিষয়। ভাল হলে কেন আমরা বিদেশী পণ্য কিনব সে প্রশ্নও তাদের।
×