ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যমেলায় মিলনস্রোত

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

বাণিজ্যমেলায় মিলনস্রোত

ওয়াজেদ হীরা ॥ শীতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে বাবার কোলে চড়ে মেলায় এসেছেন ছোট্টশিশু ইমরানুল মোমিন। মেলা কি তা বোঝার বয়স তার হয়নি। বাবা-মা কার কাছে রেখে আসবে তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। শুধু কি শিশু? তারুণ্য থেকে বৃদ্ধ ছুটির দিনে সবাই মিলেছে বাণিজ্যমেলার মিলনস্রোতে। আর দর্শনার্থীর এই হার মানিয়েছে তীব্র শীতকেও। বিনোদন আর কেনাকাটায় দ্বিতীয় শুক্রবার বেশ জমজমাট ২৩তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই সব বয়সী মানুষের কেন্দ্রবিন্দু এই মেলা। যে যার মতো পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলায় এসেছেন। সর্বপ্রথম যেন মিশে গেলো মেলাপ্রাঙ্গণে। শীত উপেক্ষা করে রং-বেরঙের শীতের পোশাকে হালকা কুয়াশায় মেলায় উপস্থিত হাজারো দর্শনার্থী। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর সংখ্যাও। দুপুর গড়িয়ে মিষ্টি বিকেলে মেলায় প্রবেশের প্রতিটি টিকেট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘলাইন দেখা গেছে। মেলায় ৫০টি টিকেট কাউন্টার। তবুও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে দর্শনার্থীকে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট সংগ্রহ করলেও আপত্তি নেই দর্শনার্থীর। শাহবাজ তানভীর বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় এসেছি, ছুটির দিন একটু ভিড় হবে জেনেও এসেছি। আর টিকেট কাউন্টারের একাধিক দায়িত্বরত ব্যক্তি জানিয়েছেন, এই শুক্রবার ভিড় বেশ বেড়েছে। গত শুক্রবারের চেয়ে অনেক বেশি বলেও জানালেন তারা। মেলা ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই মেলাস্থলে শিশুদের হৈ-হুল্লোড় আর তারুণ্যের কোলাহলে মাতোয়ারা। এছাড়া বর্তমান তারুণ্যের বিশেষ শখ সেলফি উৎসব তো আছেই। শহুরের ইট-পাথরের আবদ্ধ পরিবেশে বড় হতে থাকা শিশুরা একটু খোলা মাঠ আর মানুষের কোলাহলে নিজেরাও মেতে ওঠেন আনন্দে। বাণিজ্যমেলায় অবস্থিত দুটি মিনি শিশুপার্কই এদিন লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইডে ওঠাতে হয়েছে। সাম্পান রাইডে চড়ে বেশ উচ্ছ্বসিত শিশু কুশল। পাশে দাঁড়ানো মা মেহেরুননেসা জানালেন, সন্তানের খুশির জন্যই মেলায় আসা। তবে কিছু গৃহস্থালি পণ্যও কিনেছেন এই গৃহিণী। এছাড়া অধিকাংশ নারীই ছুটেছেন গৃহস্থালি পণ্যের স্টলে। রান্নার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ কিংবা বিছানার চাদর যা বিভিন্ন অফারে বিক্রি হচ্ছে সেখানেই দৃষ্টি রেখেছেন গৃহিণীরা। মেলায় একাধিক সবজি কাটার স্টল রয়েছে। পাকিস্তানী বা ভারতের নামে একাধিক সবজি কাটার মেশিনের স্টলেও ছিল বেশ ভিড়। বিভিন্ন ডিজাইনের সবজি কাটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গৃহিণীরা কিনেছেন পণ্যগুলো। নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো মেলায় এদিন ভেতর আর বাইরে যেন একই রকম। মানুষের ¯্রােতে মিলেমিশে একাকার। মেলার ভেতরে বিভিন্ন স্টল থাকলেও বাইরেও বসেছে একাধিক খাবারের দোকান। রয়েছে অল্প দামে হাতের চুড়ি থেকে মাথার খোঁপা পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য। মেলায় না খেয়ে কেউ বাইরে বসে ফোচকা আর চটপটি খাওয়ার স্বাদ নিচ্ছেন। আর হরেক রকম গল্পে মেতে ওঠেন। মেলার ১২তম দিনে তরুণ-তরুণীদের উচ্ছ্বাসও ছিল দেখার মতো। মেলায় প্রবেশ করে অনেকেই প্রবেশ করেন বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নে। সেখানে বিভিন্ন ডকুমেন্টারি উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ছবি তো আছেই। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতিহাস পড়ে জেনেছি বঙ্গবন্ধুকে; এখানে দুর্লভ ছবিতে সেটা স্পষ্ট। ডকুমেন্টারি যেটা প্রচার হচ্ছে সেখানেও অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী। মেলায় অবস্থিত বিভিন্ন ফুলের বাগান বা বিভিন্ন ফোয়ারার সামনে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস একটু বেশিই ছিল। এখানে নানাভাবে সেলফি নিতেও দেখা যায়। তরুণরা ছুটেছেন বিভিন্ন ব্লেজার কিনতে। আর তরুণীরা ছুটেছেন বিভিন্ন জামা আর জুয়েলারি কিনতে। জুয়েলারি বিক্রেতা তামিরুল বলেন, আমাদের বিক্রি শুরু থেকেই বেশ জমজমাট। বিভিন্ন পাথরের একাধিক কালেকশন থাকায় মেয়েদের সবই পছন্দ হয়। দামও সাধ্যের মধ্যে বলেও জানালেন বিক্রেতা। বিভিন্ন জুয়েলারি স্টলে দেখা যায় চার থেকে পাঁচজন করে বিক্রিতে নিযুক্ত তবুও ক্রেতা সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। আফসানা রুজি বলেন, বরাবই মেলায় জুয়েলারিতে নতুনত্ব থাকে। নানা ডিজাইন, নানা রকমের কানের দুল, গলার মালা জাস্ট চোখ ভরে যায়। বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে মেলায় এসে কেনাকাটা করে হাত ভরে গেছে শাহানাজ পারভীনের। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, আমার জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো এই মেলায় এসেছি। শহরে না থাকার কারণে মেলায় আসা হয়নি। চাকরির সুবাদে গত বছর থেকেই ঢাকায় থাকা শুরু সেই সঙ্গে মেলায়ও আসা। সাভার থেকে মেলায় আসা আজম হোসেন বলেন, মেলাটা উপভোগ করতে আর একটা ব্লেজার কিনতে এসেছি । বাইরে শোরুমে ব্লেজারের দাম অনেক বেশি নেয়। ১৫০০ টাকায় কিনেছি; বাইরে হলে তিন হাজার টাকা লাগত। এদিন মেলায় অবস্থিত বিভিন্ন ছাড়ের স্টলগুলো বেশ জমজমাট ছিল। ছাড়ের পণ্যগুলো ক্রেতাদের বার বার মিলিয়ে নিতে দেখা যায়। কাপড়ের ছাড়, ব্লেজারের ছাড় ছাড়াও বিভিন্ন খাবার পণ্যের ছাড়েও ছিল ভিড়। বিভিন্ন জুস, বিস্কুট, জেলি, নুডুলস, পণ্য একাধিক প্যাকেজে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এসব পণ্য ক্রয় করলে নানা জিনিস ফ্রিও দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যেখানে পণ্যের সঙ্গে বালতি ফ্রি দিচ্ছে সেসব স্টল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শিশুদের পছন্দের তালিকায় ছিল খেলনার দোকান। রিমোট কন্ট্রোল ও ব্যাটারিচালিত খেলনাসামগ্রী বেশি বিক্রি হয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। জামার পাশাপাশি তরুণীরা বিভিন্ন বডি স্প্রে ও সেন্টের স্টলেও ভিড় জমিয়েছেন। এসব স্টলে তরুণদেরও পদচারণা ছিল বেশ। বিদেশী বিভিন্ন ব্রান্ডের নানা সৌরভের সেন্ট বিক্রেতা কাজী ইমরুল বলেন, আমাদের স্টলে গত কয়েক দিনের চেয়ে ভিড় কয়েকগুণ বেশি। এমন ভিড় হলে বিক্রিও ভাল হয় জানান বিক্রেতা। এছাড়াও আগামীর দিনগুলোতেও ভাল বিক্রি হবে প্রত্যাশা তার। এদিকে, দুপুরদিকে একাধিক টিকেট কাউন্টার থেকে জানা গেছে, দুপুরের মধ্যেই টিকেট বিক্রি সন্তেুাষজনকের চেয়ে বেশি। আগামীর প্রতিটি ছুটির দিন ভিড় আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানা যায়। মেলায় দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা কর্মকর্তারা জানান, ছুটির দিনে একটু ভিড় বেশি থাকে। সামনে শেষের দিকে ভিড় আরও বেশি হয়। বিভিন্ন ফানির্চারের প্যাভিলিয়নে নানা ধরনের ডিজাইন দেখার পাশাপাশি অর্ডারও দিয়ে গেছেন ক্রেতারা। নাদিয়া, আখতার, নাভানাসহ অন্যান্য ফার্নিচার তাদের নতুন বাহারি ডিজাইন আর অফারের নানা তথ্য দিয়ে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতেও দেখা যায়। মেলা শুরুর পর ফুলদানি ও শোপিস বিক্রি তেমন একটা না হলেও এদিন সেখানেও বেশ জমজমাট লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন কৃত্রিম ফুলের সমাহারের দোকানে ক্রেতা ঘরের জন্য পছন্দসই কিনে নিয়েছেন। ১০০টি সিসিটিভির মাধ্যমে পুরো মেলা তদারকি করা হয়। আর নিরাপত্তার জন্য র‌্যাব-পুলিশ-আনসার তো আছেই। বিভিন্ন অভিযোগ ও তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য মেলায় প্রয়োজনীয় ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োজিত আছেন। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ক্রেতার পণ্য ও সেবার সঙ্গে পরিচিত করতে বাংলাদেশ ছাড়াও বাণিজ্যমেলায় ১৭টি দেশ অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
×