ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থেমে নেই চক্রান্তও

রোহিঙ্গাদের গ্রহণে মংডুতে চলছে ক্যাম্প তৈরির কাজ

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গাদের গ্রহণে মংডুতে চলছে ক্যাম্প তৈরির কাজ

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ সমঝোতা চুক্তির পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বিশেষ করে মিয়ানমার সেনা যানবাহনের ওপর সর্বশেষ আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) যে হামলা চালিয়েছে তাতে করে এক ধরনের শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে নানামুখী অপপ্রচার তো আছেই। কিন্তু এত কিছুর পরও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই। মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যমে এসেছে যে, দেশটির সরকার সুন্দরভাবে দেশান্তরী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সফল হতে চায়। প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করতে মংডু শহরের দুটি গ্রামে ক্যাম্প নির্মাণের কাজও চলছে। মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম মিজিমা শুক্রবার জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ অব হিউম্যানিটারিয়ান এসিস্ট্যান্টস, রিসেটেলম্যান্ট এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউইএইচই-আরডি) চেয়ারম্যান ড. উইন মায়েট আয়ে জানিয়েছেন, তারা সুন্দরভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনে সফল হতে চান। ওই সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, এ জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যারা তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়েছে তাদের যে কোন অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। সেখানকার জনগণও এ কাজে সহযোগিতা দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে মিয়ানমার সরকারের দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে আরসার হামলা কারও জন্যই শুভ নয়। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করছি, প্রত্যাবাসনে কোন ধরনের সমস্যা বা বিঘœ হবে না। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রসঙ্গত, ড. উইন মায়েট আয়ে একইসঙ্গে সে দেশের ইউনিয়ন সমাজকল্যাণ, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী। এর আগে গত ৭ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদী সংগঠন আরসা এক টুইট বার্তায় রাখাইন রাজ্যের মংডুতে ফের সেনাযানের ওপর হামলার দায় স্বীকার করে। এ প্রসঙ্গে পরদিন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দফতরের পরিচালক জেনারেল জো টাই গণমাধ্যমকে জানান, আরসার ওই ধরনের হামলা এবং দায় স্বীকারের পেছনে একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে নেয়ার কর্মসূচী বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তিনি বলেন, আমরা রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া বাসিন্দাদের ফেরাতে প্রয়োজনীয় সব চেষ্টাই করছি। ফিরে আসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়েছে। আগামী ১৫ জানুয়ারি নেপিদোতে অনুষ্ঠিত হবে এ সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। এর আগে দু’দেশই একমত হয়েছে যে, ২২ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। রোহিঙ্গাদের গ্রহণে মিয়ানমার সরকার রাখাইন প্রদেশের মংডু শহরের টঙপিও লেটউয়ে এবং নাগহুরা গ্রামে ক্যাম্প তৈরির কাজ করছে। এদিকে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেয়া অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে নিজভূমে ফিরে যাওয়ার জন্য কোন ধরনের উদগ্রিবতা নেই। ক্যাম্পে নিয়মিত ত্রাণ, চিকিৎসা সেবা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকায় স্বদেশ ফেরতের ব্যাপারে কোন ধরনের মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অধিকাংশ রোহিঙ্গা বলছে, আমরা যে দাবি পেশ করেছি, তা পূরণ না হলে বার্মায় (মিয়ানমার) ফিরে যাব না। টেকনাফ ও উখিয়ার অধিকাংশ আশ্রয়ক্যাম্প ঘুরে ও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মিয়ানমারে ফেরত না গিয়ে বাংলাদেশে থাকতে পারলেই খুশি। তাদের মুখে সে পুরনো কথা, আমরা নিজ দেশে রাখাইনদের অত্যাচার ছাড়াও বহু সমস্যায় ছিলাম। বাংলাদেশে বর্তমানে অনেক ভাল আছি। মিয়ানমারে এতসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া দূরের কথা, চোখেও দেখিনি। রোহিঙ্গারা উল্টো প্রশ্ন করে আরও বলছে, বাংলাদেশের কিছু জায়গায় আমরা ঝুপড়ি বেঁধে আশ্রয় নিয়েছি মাত্র। আমরা তো এখানে কারও ক্ষতি করছি না, তাহলে কেন বার্মায় ফেরত পাঠানো হবে? ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে আশ্রিতদের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া-না যাওয়ার বিষয়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে রয়েছে রোহিঙ্গারা। আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু কিছু রোহিঙ্গা কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই নিজ দেশে ফেরত যেতে প্রস্তুত। তবে তা সংখ্যায় খুবই নগন্য। দ্বিতীয়ত বেশির ভাগ রোহিঙ্গা তাদের দেয়া ৮ দফা দাবি পূরণ না হলে কখনও ফিরে যেতে চাইবে না। আর কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে তাদের জন্য দালান নির্মাণ করে দিলেও নাকি মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। শুক্রবার ক্যাম্পে অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপে তাদের মতামত বেরিয়ে আসে। কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই যারা স্বদেশে ফিরে যেতে রাজি, ওসব রোহিঙ্গারা জানায়, ছোট ছোট ত্রিপলের ছাউনিতে গাদাগাদি করে থাকার চাইতে নিজ ঘরে বসবাস শ্রেয়। তাছাড়া সেখানে জমি-জমা রয়েছে, সেগুলো দেখভাল ও চাষাবাদ করে চললে কারও মুখাপেক্ষী হতে হয় না। মিয়ানমারে যারা অপরাধী, তাদের জন্য ভয় আছে, নিরীহ রোহিঙ্গাদের মগরা মারে না। তারা আরও জানায়, রোহিঙ্গা জাতির ভেতর খারাপ লোকজন আছে। তারাই (আরসা) আজ আমাদের দেশান্তর করেছে। আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে আমরা বার্মায় বসবাস করে আসছি। অতীতে যা পেয়েছি, ভবিষ্যতে আরও কী কী পাব, সেই আশা আমাদের নেই। বাপ-দাদারা যেভাবে ইহকাল ত্যাগ করেছে, আমরাও নিজ দেশে থেকেই মারা যাব, এটাই আশা। আমরা সরকারের চেয়ে বড় নই। সরকার আমাদের অধিকার না দিলে আমরা জোর করে ছিনিয়ে আনতে পারব না। আগামীতে আরসার কোন কাজে বা কথায় কর্ণপাতও করবে না বলে জানান ফিরতে উদগ্রীব রোহিঙ্গারা। যেসব রোহিঙ্গা ৮ দফা দাবি পূরণ না হলে মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে অবস্থানে অটল রয়েছে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি।
×