ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংখ্যালঘু ও আদিবাসী কনভেনশনে বক্তাদের অভিমত

একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে দেশ এখন যোজন দূরে

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে দেশ এখন যোজন দূরে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যে চেতনার ওপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছিল তা থেকে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৪৭ বছর পরেও যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। উল্টো সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচন সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের শঙ্কিত করছে। কারণ নির্বাচন তাদের কাছে ‘উৎসব’ নয়, ‘অভিশাপ’ ও ‘আতঙ্ক’ হিসেবে আসে। নির্বাচনের পূর্বকারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তাদের নির্মম অভিজ্ঞতায় রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে শুক্রবার সকালে সিরডাপ অডিটোরিয়ামে জাতীয় সংখ্যালঘু কনভেনশনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বক্তারা। ১৯ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনের ডাকে এ কনভেনশনে রাজনৈতিক মত ও পথ নির্বিশেষে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যোগ দেন। জাতীয় সংখ্যালঘু কনভেনশনে গত ২০১৫ সালের চার ডিসেম্বরে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষাধিক জনতার মহাসমাবেশে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সাত-দফা দাবিনামাকে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে ঘোষণা করে বলা হয়, সাম্য, সমতা ও সামাজিক মর্যাদার যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তা এখনও সোনার পাথরবাটি। আগের নির্মম অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে কনভেনশন আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গভীর উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে এ মর্মে দাবি জানায় যে, (ক) কোন রাজনৈতিক দল বা জোট আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে এমন কাউকে মনোনয়ন দেবেন না যারা অতীতে বা বর্তমানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে বা রাজনৈতিক নেতৃত্বে থেকে সংখ্যালঘু স্বার্থবিরোধী কোন প্রকার কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জড়িত ছিলেন বা আছেন। এমন কাউকে নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া হলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সে সব নির্বাচনী এলাকায় তাদের ভোটদানে বিরত থাকবে বা ভোট বর্জন করবে; (খ) যে রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের প্রাণের দাবি ঐতিহাসিক সাত-দফার পক্ষে নির্বাচনী অঙ্গীকার ঘোষণা করবে এবং তাদের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিতকরণে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবে সে দল বা জোটের প্রতি সংখ্যালঘুদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে; নির্বাচনী অঙ্গীকার ঘোষণা করবে এবং তাদের স্বার্থ ও অধিকার নিশ্চিতকরণে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবে সে দল বা জোটের প্রতি সংখ্যালঘুদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে; (গ) আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণসহ জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সংসদে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহকে দায়িত্ব নিতে হবে; (ঘ) নির্বাচনের পূর্বাপর ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডাসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়কে নির্বাচনী কর্মকা-ে ব্যবহার, নির্বাচনী সভাসমূহে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান বা কোনরূপ প্রচার নিষিদ্ধকরণের পাশাপাশি তা ভঙ্গের দায়ে সরাসরি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলসহ অন্যুন তাকে এক বছরের কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান রেখে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী আইনের যুগোপযোগী সংস্কার করতে হবে; (ঙ) নির্বাচনের আগেই সরকারকে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্যে ভূমি কমিশন গঠন, বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন এবং পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পপ্তি কমিশন আইনের বাস্তবায়নসহ পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন হিউবার্ট গোমেজ। অধ্যাপক হিরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এতে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করেন। জাতীয় ঐকমত্যের সাত-দফা দাবিনামা পাঠ করে শোনান এ্যাডভোকেট তাপস কুমার পাল। ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনসমূহের জাতীয় সমন্বয় কমিটির পক্ষে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এর ওপর আলোচনায় অংশ নেন- পংকজ ভট্টাচার্য, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি, হ্যাপি বড়াল এমপি, পংকজ দেবনাথ এমপি, সুনীল শুভ রায়, ক্যাপ্টেন শচীন কর্মকার, লে কর্নেল নিরঞ্জন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ঘোষাল, রেমন্ড আরেং, বিজন কান্তি সরকার, সাংবাদিক মনোজ রায়, নির্মল রোজারিও, সোমনাথ দে প্রমুখ। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে কনভেনশন শুরু হয়। এতে কনভেনশনের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন সঞ্জীব দ্রং। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়। আলোচকবৃন্দ তাদের আলোচনায় বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার ব্যাপক উত্থানে এ দেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে বলে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, একটানা সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন, ভয়-ভীতি, হুমকি, জমি জবরদখল এমনকী ক্ষেত্র বিশেষে হত্যা তাদেরকে দিশেহারা ও নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। এতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে দেশত্যাগের প্রবণতা আবার দেখা দিয়েছে, অনেকে ইতোমধ্যে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। আলোচকবৃন্দ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ও পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে মহল বিশেষের চক্রান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ তৃণমূলে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারে জোরালো ভূমিকা পালন করছে। রাজনৈতিক স্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার বা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মেলবন্ধন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা থেকে গোটা দেশ ও জাতিকে অনেক দূূরে ঠেলে দিচ্ছে। আলোচকবৃন্দ এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, দল ও মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের স্বার্থ ও অধিকারের প্রশ্নে একাট্টা হয়ে আজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তারা বলেন, ‘নচেৎ ভবিষ্যৎ সবার জন্যেই অন্ধকার।’
×