ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাসিয়ারছড়ায় সাইকেল কন্যা

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

দাসিয়ারছড়ায় সাইকেল কন্যা

সাত সকালে বাইসাইকেলের বেলের টুংটাং শব্দ। দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারের পাশের সড়কে দলবেঁধে সাইকেলের কেরিয়ারে বই নিয়ে যাচ্ছে একদল স্কুল ছাত্রী। পিঠের ব্যাগে বই। ওরা টিউশনিতে যাচ্ছে। এর মাঝে বেলের টুংটাং শব্দে হাজির আরও কয়েকজন। কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় বিরামহীনভাবে চলা। এরা সবাই বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার সাইকেল কন্যা। দাশিয়ারছড়া নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী নূরজাহান, জেসমিন আক্তার, জান্নাতি খাতুন, নাসিমা খাতুন, মুলকি আক্তার মুন্নি, অষ্টম শ্রেণীর লিমা খাতুন, ১০ম শ্রেণীর বিপ্লবী রায়, জাহিদা খাতুন। এরা সবাই বাইসাইকেলে স্কুল যাতায়াত করে। এছাড়াও মাঝে মধ্যে নিজেদের ও পরিবারের প্রয়োজনে উপজেলা শহরে যায় সাইকেলে। অনেকে নিজের সাইকেলের ক্যারিয়ানে একজন সঙ্গী নিয়েও ছোটে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে। পুরো দাশিয়ার ছড়া যেন বদলে গেছে। যা চোখে না দেখলে বিশ^াস করা যায় না। কিছুদিন আগেও দাসিয়ারছড়ায় চলাচল নিরাপদ ছিল না মেয়েদের জন্য। পড়ালেখা ছিল শুধুই কল্পনা। মিথ্যে পরিচয়ে দু’চারজন পড়ালেখা করলেও ভাগ্যে জোটেনি চাকরি। ৬৮ বছর অবরুদ্ধ দাসিয়ারছড়াবাসী যুগের পর যুগ বন্দী জীবন পার করেছে। যেখানে ১২ বছর পেরুলেই বিয়ের পীড়িতে বসতে হতো মেয়েদের। কিশোর-যুবকরা ডুবে থাকত নেশায়। এখন মেয়েরা নির্দ্বিধায় স্কুলে যাচ্ছে। ছেলেরা স্কুলে পড়ছে। ব্যবসা করছে। আটিয়াবাড়ী গ্রাম থেকে আড়াই কি. মি. রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি বাইসাইকেলে দাশিয়ারছড়া নি¤œ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে আসেনাসিমা খাতুন। সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রতিবেশী ৫ম শ্রেণীর রিনা খাতুনকে। বাবা নূর মোহাম্মদ বলেন, স্বাধীন দেশে বাড়ির পাশে মেয়েকে পড়াতে পেরে খুব খুশি লাগছে। ব্যয় কমেছে, দ্রুত স্কুলে যেতে আসতে পারছে। নূরজাহান, লিমা খাতুন, জেসমিন আক্তার, জান্নাতি বেগম, মুলকি আক্তার মুন্নি, বিপ্লবী রায় বলেন, নিরাপদ মনে করি সাইকেলে আসতে। স্বাধীনভাবে আনন্দে চলাফেরা করছি। এভাবে স্কুলে যেতে খুব ভাল লাগছে। মুলকি আক্তার মুন্নির মা জোবেদা বেগম বলেন, তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মুন্নি সবার ছোট। এখানে স্কুল ছিল না বড়দের পড়াতে পারিনি। ছেলেরা বাইরে ভাটায় কাজ করে। মেয়েকে সাইকেল কিনে দিয়েছি। যখন সাইকেলে স্কুল যায় খুব ভাল লাগে। স্কুলে যাতায়াতের পাশাপাশি সংসারের প্রয়োজনে হাট-বাজার যায়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া সাবনাজের বাবা শাহালম খন্দকার। কম বয়সে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করছে, ব্যয় নেই, ভয় নেই। বিশ^বিদ্যালয় পড়াতে চান। সাবেক গ্রাম পঞ্চায়েত শাহের আলী মেম্বার বলেন, শেখ মুজিব যেমন দয়ালু ছিল। তার বেটিও সেমন দয়ালু। শুধু তার কারণেই আমরা দাশিয়ার ছড়ার ছিটের বন্দী জীবনের অবসান হয়েছে। ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতা গোলাম মোস্তফা বলেন, বন্দী থেকে মুক্ত হয়ে ছিটমহলবাসীরা আনন্দে আত্মহারা। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিটমহলের ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। তার অর্ধেক মেয়ে শিক্ষার্থী। মেয়ে শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ বাইসাইকেলে যাওয়া আসা করে। সত্যি খুব আনন্দের বিষয়। সাইকেলের ওপর আগ্রহ বাড়ছে তাদের। দিনে দিনে চালকের সংখ্যা বাড়ছে। গেল বছর ৩১ জুলাই মধ্যরাত আনুষ্ঠানিকভাবে ছিটমহলগুলো মিলে যায় দুই দেশের মানচিত্রে। ১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাশিয়ারছড়া পরিদর্শন করেন। সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে সরকার ৩৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৭ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চলতি বছর একনেকে পাশ করা হয় ১৮১ কোটি টাকার প্রকল্প। ৫টি নি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাতে পাঠদান শুরু হয়েছে। ৩টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। -রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে
×