ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তবু জীবিকার তাগিদে যেতে হয় কাজে

গ্রামীণ জীবনে শীত

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

গ্রামীণ জীবনে শীত

এবারের শীত পরিবার কেন্দ্রিক পিঠার নাইওর ভুলিয়ে দিয়েছে। দিনের বেলায় রেলপথে ট্রেন চলছে হেড লাইট জ্বালিয়ে। সড়ক পথে মোটরও চলছে বাতি জ্বালিয়ে। এত ঘন কুয়াশা যে দিনে বাতি না জ্বালালে পথ চলা যায় না। যন্ত্রের এই বাতির সঙ্গে জীবনের বাতি ঠিক রাখতে শীত কাবু মানুষকে জীবিকার তাগিদে পথে নামতে হচ্ছে। এবারের শীত যেন সবই ভুলিয়ে দিয়েছে। নাইওর- বাঙালীর গ্রামীণ জীবনের পরিবার কেন্দ্রিক মহাউৎসব। গত শতকের ষাটের দশকে সমাজের এই মিলনমেলা গ্রাম ছাড়িয়ে ছোট শহরেও প্রবেশ করে। এগিয়ে চলা বিশ্বে নব্বইয়ের শহুরে জীবনের নাইওর বিলুপ্ত হতে থাকে। একবিংশ শতকের পর থেকে নাইওর শব্দটি হারিয়ে যেতে থাকে। ক্ষীণভাবে যেটুকু টিকে আছে তাই এখন বাঙালীর ঐতিহ্যের সম্বল। নাইওর। আভিধানিক ভাবার্থ আছে। মূল অর্থ বাঙালীর হৃদয়ে বাঁধা। বছরের কোন এক সময়ে প্রতিটি পরিবারের আতœীয় স্বজনদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন চিরকালীন ধরে রাখতে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের বাড়িতে যেত দিনা কয়েকের জন্য। শীতের সময়টাতে লেপ কাঁথার যতই অসুবিধা হোক নাইওর যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। নাইওর না গেলে মনে হতো পরিবার থেকে কি যেন খসে পড়েছে। জামাইদের শীতের পিঠা না খাওয়ালে যেন ষোলকলা পূর্ণ হতো না। নতুন জামাই হলে তো কথাই নেই। পিঠার নিমন্ত্রণ না দিলে পাছে জামাই ‘বেজার’ (অসন্তুষ্ট) হয় এই শঙ্কায় সকল কাজ বাদ দিয়ে জামাইকে পিঠের দাওয়াত ছিল ‘ম্যান্ডেটরি’। বাঙালীর জীবনে শীতকাল আসে অগ্রহায়ণের নবান্নের পরই। কথায় আছে, পৌষের পিঠাপুলি। নতুন ধানের ম ম গন্ধের রেশ থাকতেই আয়োজন হয় পিঠার। গাঁয়ের বধূরা পিঠার জন্য আলাদাভাবে চালের আটা করে রাখে। এই আটায় কত ধরনের যে পিঠা বানানো হয় তার ইয়ত্তা নেই। নতুন ধান ঘরে ওঠার পর নাইওর আসায় খুব একটা অসুবিধা হয় না। এই সময়ে গৃহস্থ ও কিষাণ ঘরে সচ্ছলতা থাকে। আর নাইওর আনন্দে থাকে কয়েকটা দিন। সন্ধ্যায় শীতের কুয়াশা ও শিশিরের মধ্যে বাড়ির উঠানে চুলার ধারে আত্মীয়স্বজনরা গোল হয়ে বসে মাটির পাতিলে পিঠা বানানো দেখে। যারা পিঠা বানায় তাদের আনন্দের চেয়ে যারা গল্পগুজবের মধ্যে পিঠা বানানো দেখে তাদের আনন্দ আরও বেশি। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো : বানাবার সময় কেউ পিঠা খায় না। সকলের অপেক্ষা থাকে পরদিন সকালের। শীতের এই সময়টায় সন্ধ্যায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে দেখা যায়- ঘন কুয়াশা চারদিকে সবুজ মেঘ যেন। শিশির ঝরছে। অনেকটা দূরে কিছু পর পর মাটিতে ক্ষীণ আগুন। মনে হবে আগ্নেয়গিরির লাভা। গ্রামের অনেক পথই এখন পাকা। ছোট বাস, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (কেউ বলে অটো কেউ বলে টোটো) চলে। রাতে এই যন্ত্রযানও শীতে কাবু হয়ে যায়। টোটোর যাত্রীরা বরফ বাতাসে কাঁপতে থাকে। বয়স্করা গোটা শরীর কম্বলে আবরিত করার পরও কাঁপতে থাকেন। মাঝে মধ্যেই জোরে শ্বাস নিতে হয়। ঘন ঘন কাশিও পায়। শীতের কারনে হাঁপানী বেড়ে যায়। তবু তাদের জীবিকার প্রয়োজনে কাজে যেতেই হয়। গ্রামের লোকজন সন্ধ্যার পর তাদের উঠানে খড়কুটা জ্বালিয়ে চারধারে বসে শরীর তাপিয়ে নেয়। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এই ধরনের আগুন। শীত কাহিল মানুষ সকাল সন্ধ্যা আগুনের তাপ ছাড়া টিকতে পারে না। রাতে ঘুমানোর আগে খড়ির চুলার ওপর দাঁড়িয়ে শরীর তাপিয়ে নেয়। হাটবাজারগুলোতে ভাসমান চায়ের দোকানে লোকজনকে চুলার ধারে বসে চা পান করতে দেখা যায়। বর্তমানে চারকোলের আগুনের তাপ কিছুটা বেশি। তাপও নিচ্ছে, আড্ডাও দিচ্ছে। শীতের মধ্যে খুব সকালেই গ্রামের কৃষককে যেতে হচ্ছে ফসলের মাঠে। শীতে জমিতে কুয়াশার ঘন আস্তরণ পড়ে। এবারের শীতে এই আস্তরণ খুব বেশি। এই অবস্থায় আবাদ করা যাবে না। এই আস্তরণকে গ্রামের লোকজন বলে- জমি জখম হয়েছে। কৃষির পরিভাষায়- কোল্ড ইনজুরি। এই সময়টায় কৃষক বোরো আবাদের প্রস্তুতি নেয়। জমি ঠিকঠাক করার জন্য লাঙল নিয়ে যেতে হয় জমিতে। এখন আর গ্রামে হালের বলদের চাষ নেই। বেশিরভাগ কৃষক পাওয়ার টিলারে চাষ দেয়। বড় গৃহস্থের টিলার আছে। মধ্য ও ছোট কৃষক এই টিলার ভাড়া নিয়ে চাষ দেয়। এতে খরচ অনেক কম। গ্রামে এখন আর সেদিনের খড়ের চালায় বেড়া দিয়ে ঘেরা কুঁড়েঘর নেই। জীবনমান বেড়ে যাওয়ায় টিন শেডে পাকা বাড়ি হয়েছে। টিনের বাড়ি আছে। আগে বেড়ার ছিদ্র দিয়ে হীম বাতাস ঢুকতো। এখন তা ঢোকে না। তবে শীতের তীব্রতায় গ্রামের ঘরেও কাঁপতে হয়। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×