ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

দিদি... ॥ নবনীতা দেবসেনের ৮০তম জন্মদিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

 দিদি...  ॥  নবনীতা দেবসেনের ৮০তম জন্মদিন

যা শুনেছিলুম, হুবহু উদ্ধৃতি নয় হয়তো ভুল হতে পারে। মার্জনা প্রার্থী। গল্পটি এই। পিকোলো (অন্তরা দেবসেন), টুম্পা (নন্দনা দেবসেন) কিশোরী। ছেলে বন্ধুরা (মেয়ে বন্ধুরাও) বেলা-অবেলায় হরদম ফোন করে। সেদিন বিকাল গড়িয়েছে। দুই বোন (পিকোলো-টুম্পা) বাড়িতে নেই। টেলিফোন বাজলো। ধরলেন মা (নবনীতা দেবসেন)। ধরেই কড়া কণ্ঠে, ‘ওরা কেউ বাড়িতে নেই। কে বলছো হে ছোকরা?’ উত্তর ॥ সত্যজিৎ রায়। নবনীতা দেবসেন ॥ বলুন, বলুন। সত্যজিৎ রায়। ‘সন্দেশ’-এর পুজো সংখ্যার জন্যে লেখা চাই। এক সন্ধ্যায়, সত্যজিৎ রায়ের মুখেই শুনি, রসিয়ে বললেন, ‘টেলিফোনে হ্যালো না বলে, নাম না জেনে যেভাবে ধমক দিলে নবনীতা, ঘাবড়ে যাই। তোমার টিচার কী খুব ধমকান?’ বলি, ‘তিনি আমার টিচার বটে, আদতে টিচারও নন তবে। সত্যজিৎ ॥ কী রকম? তুমি কমপ্যারেটিভ লিটারেচারের ছাত্র। বিএ, এমএ পড়েছ। পড়েছি ঠিকই। তিনি টিচারের বেশি, মাতৃস্বরূপা। সারাক্ষণ ধমকে, শাসনে অস্থির রাখেন। অতিশয় বাউন্ডুলে খারাপ ছাত্র হলে মা জননী যা করেন। আদর না করলেও দুবার টাকা চেয়েছি, দিয়েছেন। সত্যজিৎ ॥ সরাসরি ‘মাতৃস্বরূপা’ কেন বলছো? মা বলি না, দিদিই বলি। ওর দুই কন্যা পিকোলো ও টুম্পা, ভাইফোঁটা দিয়েছে পরপর তিন বছর। পাকাপোক্ত দাদা হয়ে গেছি। সত্যজিৎ ॥ তুমি কী বলো নবনীতাকে? দিদি। সত্যজিৎ ॥ নবনীতার দুই মেয়ের দাদা তুমি। ফেলুদাও এই রহস্য আবিষ্কার করতে পারবে না। আরও শুনুন। অন্নদাশঙ্কর রায়কে দাদু বলি। লীলা রায়কে দিদু। ওদের পুত্রদের দাদা। পুত্রীদের দিদি। ওদের ছেলেমেয়ে আমাকে বলে দাদা। সত্যজিৎ ॥ জটিল সম্পর্ক। এসব বাঙাল ব্যাপার না কি? অধ্যাপককে আমরা স্যার বলি। অধ্যাপিকাকে দিদি। স্যার-এর যুৎসই স্ত্রীলিঙ্গ নেই বলেই বোধহয়। বিশ্বভারতীতে কোন ঝুটঝামেলা নেই। অধ্যাপককে ‘দাদা’ও নয়, সরাসরি ‘দা।’ অমুক দা। এমন কী উপাচার্যকেও। অধ্যাপিকা চিরাচরিত দিদি। বাংলাদেশে অধ্যাপক ‘স্যার’, অধ্যাপিকা ‘আপা।’ একে শিক্ষিকা, তায় আবার দিদি। নানা আবদার। বকাঝকাও কম করেন না। করার অধিকার ষোলোআনা। কবিতায় ছন্দ-মাত্রায় গোলমাল হলে, কিংবা অপাঠ্য গদ্যপদ্য লিখলে রক্ষে নেই আর। আরেক রকম শাসন। সবই স্নেহমাখা। তার সব ছাত্রছাত্রীর অবাধ প্রবেশ ৭২ হিন্দুস্তান পার্কের ‘ভালোবাসা’ বাড়িতে। তিন তলা বাড়ি। নিচের তলা ফাঁকা। দোতলায় থাকেন দিদি। তিন তলায় অপরাজিতা দেবী (রাধারানী দেবী), পিকোলো এবং টুম্পা। ছাত্রছাত্রীর অবাধ প্রবেশ বটে, তবে খুব বেশি ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা চোখে পড়েনি। মাঝে মধ্যে দুই-একজন। অনুমান করি, ক্লাসে তিনি গম্ভীর, রাশভারী। কিন্তু বাড়িতে ঘরোয়া। অমায়িক। সহৃদয়। দিলখোলা। প্রাণবন্ত। যেন সমসাময়িক। ছাত্রশিক্ষকের সম্পর্ক বজায় রেখেও দূরত্বের ব্যবধান মুছে দেন। আপন করে নেন সহজেই। সহজ এবং আপনতার মধ্যে যে আন্তরিকতা, কঠিন কোমলে যে আভিজাত্য, যে-বোধের শ্রী, সামঞ্জস্য, ব্যক্তির বিশ্বভুবনের ঘনঘটা পারিবারিক। নবনীতা দেবসেনের পিতা কবি-প্রাবন্ধিক-অনুবাদক-সম্পাদক নরেন্দ্র দেব। মাতা কবি-প্রাবন্ধিক-গল্পকার রাধারানী দেবী। তাদের একমাত্র সন্তান খুকু, নবনীতা। রক্তেই তার সাহিত্য, সাহিত্যের সবোধ্যতা। সংহতির আবিষ্টতা। বহুলতা শিকড়ের বিচ্ছুরণ। নবনীতা দেবসেন (অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ের পরে ‘সেন’ যুক্ত। দুই কন্যার জন্মের পরে বিবাহবিচ্ছেদ। সেন পদবী মোছেননি।) তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ যে বছর খোলা হয়, সেই বছরই (না কি পরের বছর? সঠিক অজানা।) হাতেগোনা কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিভাগ চালু। বুদ্ধদেব বসু চালু করেন তুলনামূলক সাহিত্য। তিনিই প্রথম ছাত্রী। ওর অধ্যাপককুলে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো বহুমান্য কবি, প-িত। স্বাভাবিক, নবনীতার পরিশীলিত সাহিত্য মননবোধ তৈরি হয়ে গেছে ছাত্রীকালীনই। সাহিত্য বিচারেও মননজাত মাপকাঠি আধুনিকতার বিভাসে উদ্ভাসিত। পড়েছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও। নবনীতা দেবসেনের (তখন ‘নবনীতা দেব’) বয়স মাত্র ২১, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ-ি পেরোননি, প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত (১৯৫৯), নামও ‘প্রথম প্রত্যয়।’ লক্ষণীয় গ্রন্থের নাম। ‘প্রত্যয়’ মূলত প্রতীতি, তথা বিশ্বাস। গোটা কাব্যে নিজের বিশ্বাস স্থাপনা, হোক তা হৃদয়াত্মক। ওই বয়সে, প্রেম-হৃদয় নিয়ে, অধিকাংশ কবিই : ঘটনা বিস্ত অভিনব হৃদয়ে তো সেই চিরন্তন মধ্যরাতে অমৃতসম্ভব পূর্ণকোনো নিভৃত মরণ (রেখা) দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্বাগত দেবদূত’। প্রকাশকাল ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন। কবিতাগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে লেখা। লিখেছেন ইউরোপ-আমেরিকা বিদেশবাসে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তে আমি রাজপুত্র’, ১৯৭২-৮৮ সালে রচিত কবিতা, আগের গ্রন্থে নয়, এই গ্রন্থেও, আশ্চর্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে একটি কবিতাও লেখেননি। স্পর্শ করেনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা? ওর গুরু বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন। দিলীপ কুমার রায়, অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ লিখেছেন। অথচ তিনি অসমের ‘বঙ্গাল-খেদা’ সমস্যা নিয়ে লিখতে স্বতঃস্ফূর্ত। কবিতার শিরোনাম ‘আসাম, ১৯৮০।’ পঞ্চাশ দশকের তিন ‘মহিলা’ কবির মধ্যে নবনীতা দেবসেনই অগ্রগণ্য, সন্দেহ নেই। ওর কবিতায় দেশসমাজ বিশ্ব বিস্তারিত। এক অর্থে বৈশ্বিক। বিশ্ব অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। নবনীতা দেবসেনের মতো কোন বাঙালী ‘মহিলা’ কবি (পুরুষ কবিকুলে একমাত্র অমিয় চক্রবর্তী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নন।) বিশ্ব ভ্রামণিক নন। ভ্রমণ নিয়ে তাঁর মজার অভিজ্ঞতা, সরস লেখা। নবনীতাকে নিয়ে ওর সমসাময়িকের অনেকের ঈর্ষা। কারণও আছে। নবনীতার মতো ভার্সাটাইল জিনিয়াসও কম। লেখেন দুই হাতে। কবিতা। প্রবন্ধ। গল্প। উপন্যাস। রস রচনা। সাহিত্য একাডেমি জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের বিচারক ম-লীর অন্যতম। বাংলা-ইংরেজী পা-িত্যে আলোকবর্তিকা। তিনি সর্বকুলে। দিদির ‘ভালো-বাসা’য় কেন যেতুম? উদ্দেশ্য, দিদির মা রাধারানী দেবীর পদতলে বসার। তাঁর কাছে শুনতুম রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের গল্প। ওদের নানা চিঠি পেয়েছেন। দিদি, নবনীতা দেবসেন, তাঁর ছাত্র, পাঁচ বছর, তুলনামূলক সাহিত্যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। জন্মদিন দিদির। জন্ম ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮। ৮০তম জন্মদিন। ছাত্রের শুভেচ্ছা। ১১ জানুয়ারি ২০১৮, বার্লিন, জার্মানি
×