ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রুশো তাহের

বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপপুর

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপপুর

সেপ্টেম্বর ২৬, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটারে ‘ইন ফ্যাক্ট-২০১৭’ বিজ্ঞান উৎসব হয়। ওই দিন ছিল উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। মূলত ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উৎসব চলে রাজধানীর বিভিন্ন ভেন্যুতে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মাঝে পারমাণবিক শিল্প সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলা। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার মাধ্যমে। তিনি আমার ই-মেইল ঠিকানায় আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন। যথারীতি ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল-সকাল বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমি বুঝি অনেক আগে চলে এসেছি এটা ভাবতে-ভাবতেই দেখলাম বিদেশীদের নিয়ে একটি গাড়ি নভোথিয়েটারের গেটে থামল। তাদের আলাপচারিতায় বুঝলাম, এরা রাশিয়ান। মানে, আজকের উৎসবে এরাও এসেছে। ভেতরে প্রবেশের সময় রাশিয়ান এক তরুণী গুডমর্নিং বলল। আমিও উত্তর দিলাম। যা হোক, অনুষ্ঠান শুরু হলো নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা বিলম্বে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব কেউ ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন না। পরে জানলাম, তাদের সঙ্গে যোগাযোগই করা হয়নি। তারপরও বলতে হয়, অনুষ্ঠান ভালই হয়েছে। রোসাটমের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক কমিউনিকেশন প্রধান মি. অ্যালেক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ড. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে আমার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। সেটা হলো- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচীর কথা। বিশেষত, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট সংশ্লিষ্টরা নভোথিয়েটারের নিউক্লিয়ার ইনফরমেশন সেলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেন। ভাবখানা এমন যে, জনসচেতনতার সব কাজই নিউক্লিয়ার ইনফরমেশন সেল যথাযথভাবে করছে। আসলে কী তা-ই? মানে, নভোথিয়েটারের নিউক্লিয়ার ইনফরমেশন সেলের কার্যক্রমের মাধ্যমে কী পরমাণুভীতি দূর হচ্ছে? ‘ইন ফ্যাক্ট-২০১৭’ বিজ্ঞান উৎসব আয়োজনের অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে নবাগত দেশ হিসেবে যে ধরনের প্রচার কর্মকা- পরিচালনা করা প্রয়োজন; বিশেষত, শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাদার অব হিউম্যানিটি ও শান্তির দূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্ব নিউক্লিয়ার ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা যাদের গাত্রদাহ, তারা নানা মোড়কে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে রূপপুরের বিরুদ্ধে। ক্ষেপিয়ে তুলছে জনগণকে এমনকি তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে দেশের দশজন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী রূপপুর প্রকল্প চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে যৌথ বিবৃতিও দিয়েছিল। যা ফলাও করে প্রচার করেছে রূপপুর-বিরোধী প্রচারণায় মুখর কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের একটি দৈনিক। এই বাস্তবতায় কী-কী জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের। যাকে অনেকটা এক্সটার্নাল মিডিয়া কনসালটেন্সি বলা যেতে পারে। একই সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছি যাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাদার অব হিউম্যানিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মহান কর্মযজ্ঞকে কোন অপশক্তি বাংলাদেশের আপামর জনগণের নিকট নেতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। বস্তুত, এক্ষেত্রে আমি নানা মাধ্যমকে ব্যবহার করছি। এর একটি হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি’। আমার মনে হয়েছে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের মিডিয়ার অপপ্রচারের জবাব একমাত্র বিটিভির মাধ্যমেই সুচারুভাবে দেয়া সম্ভব। ২০১০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে মানে জুলাই মাস থেকে আমার গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় বিটিভিতে শুরু হয় বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’। প্রথমদিকে এটি ছিল পাক্ষিক অনুষ্ঠান, পরে সাপ্তাহিক হয়। ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’ এই শিরোনামের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়ই অধিকতর মানানসই হয়। কিন্তু অনুষ্ঠান ডিজাইনে আমি প্রকৃতিবিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গভাবে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করেছি এবং সেই আঙ্গিকে প্রতিটি পর্ব নির্মাণ করেছি। কারণ বিজ্ঞানকে খ-িতভাবে জানলে কী কী বিপদ হতে পারে, তা নতুন করে বলার অবকাশ নেই। আসলে বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্নভাবে জানালে নানা রকম অসঙ্গতি এমনকি অন্ধত্বও সৃষ্টি হতে পারে মানসপটে। যা হোক, পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন কিংবা দেশে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও তত্ত্ব প্রচার করা হচ্ছে, তা যে বিজ্ঞানবিরুদ্ধ সেদিকটি বিজ্ঞানের আলোকেই সুরাহা করতে হবে। আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’ অনুষ্ঠানে সেই কাজটিই সম্পন্ন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’র স্টুডিও রেকর্ডিং-এ রূপপুর নিয়ে বলার জন্য অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নঈম চৌধুরী ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর। ওই আলোচনায় উঠে এসেছিল ১৯৭৯ সালে সংঘটিত আমেরিকার থ্রি-মাইল আইল্যান্ড, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল ও জাপানের ফুকুশিমা দাইচির নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার নানা দিক। এবং ওই সব দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ কেন বাংলাদেশের রূপপুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তা-ও স্পষ্ট করেছিলেন আলোচকদ্বয়। এরপর একাধিক পর্বে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। তিনি নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের সাইটিং লাইসেন্স প্রদানের ধাপসমূহ ব্যাখ্যা করেছিলেন। রূপপুর নিয়ে আলোচনার আমাদের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক। তিনি এখন বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সম্মানিত মেম্বার। রিএ্যাক্টর প্রযুক্তির ওপর ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’ অনুষ্ঠানে অনুপুঙ্খ বলেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জীবন পোদ্দার। নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট রাশিয়া ফেরত নেবে না এই মর্মে প্রচারণা চালিয়ে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের দৈনিকটি সাধারণ মানুষ এমনকি বিশেষজ্ঞদের ভয় পাইয়ে দেয়ার অপকর্মটি করেছিল। আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘মহাবিশ্বের পথে পথে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের মিথ্যাচারের জবাবের ব্যবস্থা করেছিলাম। বস্তুত নিউক্লিয়ার ফুয়েল সাইকল, নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, নিউক্লিয়ার সেফটি প্রভৃতি শিরোনামে কয়েকটি পর্ব করেছিলাম। এসব বিষয়ের ওপর বলেছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ৩০ নবেম্বর, ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈশ্বরদীর রূপপুরের পদ্মা পাড়ে প্রথম কংক্রিট ঢালাই (এফসিডি) উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করে। রূপপুরে প্রথম কংক্রিট ঢালাই অনুষ্ঠানকে সামনে রেখেও আমার গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় ২৯ নবেম্বর, ২০১৭ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘রূপপুর : একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন’ বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। যাতে সার্বিক সহযোগিতা করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আনোয়ার হোসেন। ওই আনুষ্ঠানে সচিব মহোদয় রূপপুর প্রকল্পের প্রথম কংক্রিট ঢালাই বা এফসিডি আসার পূর্ববর্তী ধাপগুলো বিশদ ও প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছিলেন। আর প্রকল্প পরিচালক ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর রূপপুরের প্রযুক্তিগত দিকটি উপস্থাপন করেছিলেন, যা পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বৈকি। উপরন্তু বার্তা বিভাগকে রূপপুরে প্রথম কংক্রিট ঢালাই অনুষ্ঠান সামনে রেখে নিউজ ডিজাইনে পরামর্শ দিয়েছিলাম। বার্তা বিভাগকে এই সহযোগিতা করতে আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন শ্রদ্ধাভাজন পরিচালক (বার্তা) কবি নাসির আহমেদ। বস্তুত এভাবেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে রূপপুর উঠে এসেছিল। লেখক : বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও গবেষক
×