ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ খাণ্ডবদাহন

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

গল্প ॥ খাণ্ডবদাহন

জীবনের খণ্ড খণ্ড স্মৃতি কখনও অন্তর্জগতে আঁচড় কাটে বুনো বেড়ালের নখরের মতো। আবার কখনও কঠিন শিলার ফাটল দিয়ে খেলে যায় দুপুরের খা-বদাহের এক টুকরো ঝিলিক। মনের গভীরের একান্ত নিবিড় স্পর্শে চোখ মেলতেই রবীন্দ্রনাথ, ডানে জীবনানন্দ, ঠিক একটু সরে নজরুলের, বাঁ দিকে তাকটার শেষ কর্নারে জয়নুলের শিল্পকর্ম, আর খাটের বরাবর যাকে অহর্নিশ মনে, চোখ খুললে, একেবারে আড়ালের নয় কখনও- ওটা নীলার্ভর ছবি। আর একান্ত গোপনে হৃদয়ের খুব ভেতরে এক টুকরো কষ্টের মতো নির্ঝরের ছবি। ছবিটা ইদানীং কেমন যেন ঝাপসা মনে হয়, বহুদিনের পুরনো কাঁচের মতো। কখনও কখনও হঠাৎ পড়ে গিয়ে ভেঙে যাওয়া চারকোণা আয়নার মতো ভাঙাচোরা। বুকের ভেতর থেকে দলা পাকানো একটা কষ্ট বেরিয়ে এসে গলার কাছে থেমে যায়। এখনই বুঝি নিভে যাবে পৃথিবীর সব আলো, এই বুঝি প্রলয় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত কষ্টের বসতি। না, এর কিছুই হয় না। দীর্ঘশ্বাস গলা ভেদ করে মিশে যায় পৃথিবীর আকাশে। অর্থি এদিক ওদিক চেয়ে হাত দিয়ে অনুভব করতে চায় কষ্টকে। স্পর্শ করতে চায় কষ্টের ছোঁয়া। কই, কোথাও তো নেই। চোখ দিয়ে চারদিকেই চেয়ে দেখে, যদ্দূর দৃষ্টির সীমানা, ঠিক তদ্দূর। কোথাও চিহ্ন রেখে যায়নি। না। তার ধারণা নিমিষেই ভুল প্রমাণীত হয়। হাত দেয় বুকের মাঝখানে। একটু বাঁ দিকে সরিয়ে ঠিক বাম স্তন্যের গায়ে যে খানটায় কালো তিল, তার ঠিক ওপরে। এখান থেকে কষ্ট উধাও হয়নি, ঠিক যতখানি গাঢ়ভাবে জমেছিল। একেবারে শেকড় গেড়েই রয়েছে। ডালপালা গজিয়েছে। কিন্তু এইমাত্র যে কষ্ট বেরিয়ে গেল দেহ থেকে তার এক তিলও কমাতে পারিনি। আসলে তো তাই হয়, ধরিত্রী থেকে কমে না কিছুই। যা কিছু চিরন্তন তা তো চিরন্তনই। মিথ্যে যাওয়া আর না যাওয়ায় কি এসে যায়। আর কারই বা এসে যায়। এখনও ঘড়ির কাঁটা বারো ছোঁয়নি। আর ছুঁলেই বা কি? অর্থি একটানে খুলে ফেলে শাড়ির আঁচল। দাঁড়ায় আয়নার সামনে। হাত দেয় ব্লাউজে...। দু’স্তন্যের মাঝখানে কালো দাগ। শিউরে ওঠে। হাত দেয় শাওয়ারের সুইচে। আঃ.. কী শীতল জলের ধারা, কী পরম শান্তি। এবার সে চোখ খোলে। জলের ধারা খানিকটা কমিয়ে দেয়। নিজের প্রতিবিম্বকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হাত রাখে ঠিক সেখানে, যেখানে মাতৃত্বের দাগ। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এ অনুভূতি একেবারেই অর্থির নিজস্ব। শ্যামলা মেদহীন তলপেটে আঁকা বড় দাগগুলো মনভরে দেখে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে তার প্রতিটি বিন্দু। হঠাৎ জলের ধারা বাড়িয়ে দেয়, কারণ অর্থি এবার নিজের বুকের মধ্যে ঝরনার চেয়েও বহুগুণ জলের বয়ে যাওয়া অনুভব করে। ফোনটা বেজেই চলে অনবরত, বিরামহীন। ইচ্ছে করেই অর্থি আমলে আনে না। ফোনের আওয়াজ শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। সে জলের ধারা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে এখন একটা বেজে পনেরো মিনিট। চৌদ্দ অক্টোবর। ক্যালেন্ডারের পাতায় চৌদ্দ অক্টোবর তারিখ নীলরঙের কালি দিয়ে দাগ এঁকে রাখা। তারপর সোজা রান্নাঘরে এবং শেষমেষ কফির মগ হাতে পুনরায় রবীন্দ্র, নজরুল, জয়নুল বেষ্টিত ঘরেই প্রত্যাবর্তন। অর্থি এখন ইচ্ছে করলেই যা খুুশি তাই করতে পারে। নিজে নিজে ভেবে নেয় পুনরায়। আসলে সে কী করতে পারে? হ্যাঁ সে সমস্ত ঘরময় পাঁয়চারী করতে পারে, ইচ্ছে করলে শাওয়ারে সারা রাত ভিজতে পারে, ফেলে দিতে পারে ঘরের সমস্ত ছবি, এমন কি তার প্রিয় নামটাকেও এখন সে মুছে দিতে পারে। আর সে কী পারে? সে কি ইচ্ছে করলেই পারে চৌদ্দ অক্টোবর ভুলতে, মাতৃত্বের দাগ মুছে ফেলতে কিংবা সারা শহর একা একা ঘুরে বেড়াতে। আসলে সে কিছুই পারে না। পারে না কিছুতেই তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে। যেমন পারে না পদ্মার তীরে বিকেলের পরন্ত সূর্যের আভা গায়ে মেখে সূর্যমুখো হয়ে সূর্যস্নানের কথা ভুলতে, আবার সে ইচ্ছে করলেই সূর্যস্নাত হতে পারে না। ভাবনায় ছেদ পড়ে না কিছুতেই। মাথাটা কেমন ঝিম মেরে আসে। চোখের পাতাগুলো কেমন যেন নড়েচড়ে ওঠে। আরেক মগ কফি খেতে ভীষণ ইচ্ছে করে। হঠাৎই বুঝি আকাশে ভীষণ মেঘ করে। গর্জে ওঠে সমস্ত পৃথিবী। অঝোরে বৃষ্টি নামে। অর্থি জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দেয় দু’হাত। আর চিৎকার করে বলেÑ আমি ভালো নেই। আমি ভালো থাকিনি। নির্ঝর তুমি কেমন আছ? তুমি ভালো থেকো। আজও বৃষ্টি নেমেছে। আমি বৃষ্টি ছুঁয়েছি। নির্ঝর তাকিয়ে দেখো আমি বৃষ্টি ছুঁয়েছি। বৃষ্টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওকে মেখে নিচ্ছি সমস্ত শরীরে। নির্ঝর! নির্ঝর! প্রচ- জ্বরের ঘোরে অর্থিকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেছে পাশের ভাড়াটিয়া। মফস্বল শহরে এটুকু আন্তরিকতা না থাকলে অর্থির কী হতো সে নিজেই জানে না। সে গতকাল রাতের কথা তেমন কিছুই মনে করতে পারে না। শুধু এটুকু মনে করতে পারে, কাল রাতে প্রচ- বৃষ্টি হয়েছিল, সে জানালা খুলে দু’হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়েছিল। জানলার ওপারে পাখা মেলে ভিজছিল দুটো চড়ুইপাখি। না ঠিক চড়ুই না, রাতের বেলা ওরা তো ঘুমিয়ে... আর কিছুই মনে করতে পারে না অর্থি। ডাক্তার এসে থার্মোমিটার দেয় জিভের নিচে। তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার গা স্পঞ্জ করতে আর ওষুধ খেতে দেয়। কেবিনের চারধার ফুলে ফুলে ভরে গেছে। অর্থি মফস্বলে থাকলেও সে এখানে বেশ পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। এমন কম মানুষই আছে যারা ওকে ভালবাসে না। আসলে অর্থিকে ভালো না বেশে পারা যায় না। এই মফস্বল শহরেও তার লেখার ভক্ত অনেক। কলেজের জুনিয়র থেকে শুরু করে সিনিয়র সব শিক্ষকরাই অর্থির লেখা পছন্দ করে। আজ আর তেমন জ্বর নেই। ডাক্তার বলেছে বিকেলের দিকেই ছাড়পত্র দিয়ে দেবে। আজ মনও সকাল থেকেই ভালো আছে তার। সকালে অনেক ভক্ত এসেছিল। এইমাত্র কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার উঠলেন। প্রিন্সিপ্যাল স্যার অর্থিকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। অর্থিও তাই একটু বেশিই প্রশ্রয় নেয়। গল্পে গল্পে প্রিন্সিপ্যাল স্যার তার মেয়ের কথা বলেছিলেন। যে জন্মের মাত্র এক মাসের মাথায় নিউমোনিয়ায় মারা যায়। কাকতালীয়ভাবে অর্থির সঙ্গে সেই ক্ষণজন্মা মেয়েটির জন্মতারিখও এক। সেই সুবাদেই প্রিন্সিপাল স্যার ও তার স্ত্রী অর্থিকে তার মেয়ের মতোই আদর-স্নেহ করেন। অর্থির সুখে-অসুখে পাশে থাকতে পারলে খানিকটা সুখবোধ করে। অর্থিও তাই মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও কিছু একটা বলে না। বলতে পারে না। মাঝে মাঝেই প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর ছোট ছোট অনুরোধ মেনে চলতে হয়। জীবনে সে অনেক ভালোবাসা পেয়েছে। হারিয়েছেও। কোনও পাল্লা ভারি সে মাপামাপিতে সে কোনও দিনই যেতে চায় না। তার মন তো সব সময় ভরেই থাকে, সে সুখে হোক আর অসুখে হোক। কষ্টে থাক আর আনন্দে থাক। আজ কেমন আছেন? ভাবনায় ছেদ পড়ে সহকর্মীর প্রশ্নে। ভালো। কবে ছাড়বে? বোধ হয় আজই। যে উপন্যাসটা আরম্ভ করেছিলেন সেটা কদ্দূর এগোল? এই তো, এগোলো আর কই। কেন ? জ্বর যে আমার প্রেমে পড়ল। প্রেম কবে নাগাদ ছেড়ে যাবে বলে মনে হয়? বোধ হয় আজই। বলেন কি, এত সহজে ছাইড়া যাওনের পাবলিক তো হে না। হেসে ওঠে অর্থি। বাঁ চোখের কোণে কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া খেলে যায়। সহকর্মীর চোখে সে বিষাদের ছায়া হয়তো ধরা পড়ে না। গল্প চলে তার মতো এগিয়ে। বিকেলেই ক্লিনিক থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। জ্বর একেবারেই আসেনি। তবে শরীরটা একটু একটু দুর্বল। বিছানায় আর ভালো লাগে না অর্থির, বিছানা ছেড়ে নীলার্ভর ছবির সামনে দাঁড়ায়। নীলার্ভ তার আত্মার সূত্র। ভালোবাসার চিহ্ন। তার জরায়ুর একান্ত নিবিড় যোগসূত্র। প্রত্যহই নীলার্ভর ছবিটা মোছে। এই চার দিনেই ধুলো জমেছে ছবিটার গায়ে। দেয়াল থেকে ছবিটা নামিয়ে আনে সে। তারপর টিস্যুর প্যাকেটে হাত দিয়েই সরিয়ে দেয়। সেই মান্ধাত্তার আমলের নারীদের মতো আঁচল দিয়ে পরম যতেœ ছবিটা মুছে চুমু খায় তারপর টাঙিয়ে রাখে দেয়ালে। দেয়ালে টানানো ছবিটার সঙ্গে বুকের ভেতরে রাখা নীলার্ভরের ছবিটায় একবার চুমু খায় কপালে, গালে, ঠোঁটে। শিরিষের দুহাত ছিন্ন করে চলে গেছে মসৃণ কংক্রিটের রাস্তা। আর কংক্রিটের রাস্তা থেকে ডানে চলে গেছে হেরিং। পাশ দিয়ে দেবদারু আর রেইন্ট্রি। ঘোর অমাবশ্যা, থিসিসের কাজ চলছে। কফির চেষ্টায় দু’জনে কাজ ছেড়ে হেরিঙের রাস্তা দিয়ে হাঁটে। হঠাৎ ঘোর অন্ধকার, লোডশেডিং। নির্ঝরের হাতটা শক্ত করে ধরে অর্থি। নির্ঝর বুকের খুব কাছে টেনে নেয় অর্থিকে। দেবদারু আর রেইন্ট্রির ঘন আড়ালে চলে যায় ওরা। নির্ঝরের শরীর তখন সাপের মতো ঠা-া আর সর্পিল। ক্যাম্পাসের অন্ধকার ওদের শীৎকার ধ্বনি শোনে আর ওদেরকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলতে লোডশেডিং বেড়েই চলে। আজকাল প্রায়ই আনমনা থাকে অর্থি। থিসিস জমা দেয়া হয়েছে। মা, মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে বলতে পারে না সে। নির্ঝরের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রাও কমে গিয়েছে। কারণ হিসেবে নির্ঝর একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছে, বাড়িতে ব্যস্ত তাই সময় হচ্ছে না। যে ভ্রƒণ অর্থি বয়ে নিয়ে বেড়ায় নিজের মধ্যে, তার একটা সফল পরিণতি দেয়ার কথা নির্ঝরকে জানিয়েছে। নির্ঝরও রাজি হয়েছে। শুধু গোছগাছের জন্যে অল্প দিনের অপেক্ষা...! হাত দিয়ে অর্থি স্পর্শ করে মাতৃত্বের দাগ। বাড়ি থেকে অ্যাবর্সনের কথা সকলেই বলেছিল। অর্থি রাজি হয়নি। নির্ঝরের ভালোবাসার চিহ্ন নিয়েই সে সারা জীবন কাটাতে চেয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তার মা তাকে রাজি করতে পারেনি। যে অনাগত সন্তান পৃথিবীর আলো অনুভব করার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে একথা অর্থি মনে প্রাণে চায়নি। বিধাতা বুঝি হেসেছিল সেই অদৃশ্য হাসি। হেসে ছিলই তো। অর্থি তখন ঢাকায়। মিরপুরে দুকামরার একটা ভাড়া বাড়িতে সে থাকে, সঙ্গে বয়স্ক গৃহকর্মী। হঠাৎ একদিন বাথরুমে পা পিছলে যায়। মরে যায় অর্থির স্বপ্ন। দেয়ালে টানানো অর্থির নিজের হাতের অনভ্যস্ত আঁকিবুঁকিতে কোনও শিশুর মুখাবয়ব ফুটে ওঠেনি ঠিকই কিন্তু অর্থি ওর নাম দিয়েছে নীলার্ভ। নীলার্ভের বয়স এখন চৌদ্দ। আজ অর্থি তার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে। শাড়িটা নীলার্ভের জন্যে জীবনের প্রথম শাড়ি উপহার। তবুও তার মুখ গোমড়া। বোধ হয় শাড়ি পছন্দ হয়নি। দুপুর থেকে নানাভাবে মান ভাঙানোর চেষ্টা চলছে কিন্তু কিছুতেই মান ভাঙাতে পারছে না অর্থি। মাকে বড় বেশি জ্বালাচ্ছে সে। জ্বালাবেই তো মাকে, মাকে ছাড়া আর কাকেই বা সে জ্বালাবে। নিজের মনেই হেসে ওঠে অর্থি। জন্মদিনেও মেয়েটার মুখে এতটুকু হাসি নেয়। চোদ্দটি নীল রঙের মোমের মাঝে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে নীলার্ভকে। অর্থিও আজ পড়েছে নীলর্ভর জন্মক্ষণের শাড়িÑ গাঢ় নীলরঙের। আজ চৌদ্দ তারিখ, নীলার্ভের চৌদ্দতম জন্মক্ষণ। নীল রঙের চৌদ্দটা মোমের আলোয় সামনে অর্থি। তার ডাইরির কাভার পেজ নীল, কলমের রং নীল এবং তার বুক বিদীর্ণ করে যে কালি ছড়াচ্ছে সাদা কাগজের পাতা, তার রঙও নীল। আজ অমাবশ্যা। নিভে গিয়েছে পৃথিবীর সব আলো। বাইরে লোডশেডিং। অর্থির কলম ছুটছে সাদা কাগজের পাতায়। চারদিকে কোলাহল মুখর পরিবেশ স্পর্শ করছে না অর্থির মনোযোগ। মফস্বলের আখক্ষেত দিয়ে দু’একটি শেয়াল ডেকে দৌড়ে গেল কী না গেল, গ্রাম্য কোনও বধূর জরায়ুতে এইমাত্র জন্ম হলো কোনও ভ্রƒণের, কোনও মার বুক থেকে হারিয়ে গেল সন্তান, আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে এইমাত্র ভরিয়ে তুলল কোনও প্রেমিক তার প্রেমিকার শরীর কিংবা অপাপবিদ্ধ সন্তান জন্মের লজ্জায় শ্লিপিং পিল মুখে ফেলে দিল কোনও নারী। যৌন পল্লীতে একমাত্র জন্ম নিল কোনও কন্যাশিশু। অথবা পারমাণবিক বোমায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হলো পৃথিবীর সম্পদ, কেড়ে নিল পৃথিবীর অগণিত মানুষের প্রাণ। এসব কত কিছুই না ঘটছে পৃথিবীতে অথবা ঘটতে পারে। সব কিছুই ঘটতে পারে, সম্ভব। একজন অর্থি লিখছে তার জীবনের গল্প, তার মতো হাজারও মানুষের জীবনের ছোট ছোট গল্প। সে রাতের পর রাত জেগে ভরিয়ে তুলছে কাগজের পাতা। সে তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, নিজের জীবন দিয়ে সে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে কিংবা যে সব তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে সে তা লিখে চলেছে। সে লিখছেÑ ঘড়ির কাঁটার মতোই হৃদয় চলছে টিক টিক আওয়াজে। ঘুরছে পৃথিবী, ঘুরে ঘুরে নিজ কক্ষপথের ওপর দিয়েই ক্রমাগত নিজের কাছেই সে ফিরে গেছে ক্রমাগত। কিংবা অন্তহীন জলের কাছে সে ফিরবে না কোনদিন। কিংবা সে ফিরে আসবে আজ অথবা কাল। সে ফিরবে অন্য কোনও শরীরে। অন্য কোনও জরায়ুতে অথবা অন্য কোনও ভ্রƒণে। এ পৃথিবীতে একমাত্র প্রেম চিরন্তন। মানুষ তার বোধ, বুদ্ধি, মনন এবং সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই জেনেছে এই সারটুকু। এ সঞ্চয়টুকু বুঝতে বুঝতে কাটিয়ে দিয়েছে বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ, জীবনের পর জীবন। মানুষ ফেরে ভালোবাসার কাছে অথবা ভালোবাসা ফেরে মানুষের কাছে। হয়তো কেউই কারও কাছে ফেরে না। যে জলের স্পর্শ পেতে মানুষ সমুদ্রের কাছে যায় তার স্বাদ নোনা, যে রক্তের প্রবাহ বয়ে বেড়ায় মানুষ তার স্বাদও নোনা। কষ্টের স্বাদ নোনা। আসলে ভালোবাসার স্বাদ নোনা। জলের আর জীবনের এই যে আলিঙ্গন, আমি এর নাম দিয়েছি নোনা। এ যেন একখ- অবশ পাথর। তার কোনও ক্ষয় নেই, নড়া নেই, বাড়া নেই, কমা নেই। অবিনশ্বর। আমি পেয়েছি সব কিছুর স্বাদ। ভালোবাসা আমায় দিয়েছে সীমাহীন স্বাধীনতা। আর দুঃখ আমাকে দিয়েছে অনাবিল আনন্দ। দুই-ই মিলে পরিপূর্ণ আমি। এর মাঝেই চলমান আমি, কখনও সুখানুভূতি আবেশে আমাকে জড়ায়। ঠিক বহু দূর দিয়ে উড়ে যাওয়া চিলের মতো, আবার কখনও অতিথি পাখি হয়ে দুঃখরা আমাকে ভরিয়ে তোলে। আমাকে দেয় সুখ-দুঃখ এ দুইয়ের মাঝখানে এক অন্য রকম অনুভূতি। প্রেম মরে না। রূপান্তর হয়...।
×