ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আফসারা তাসনিম

প্রাণীরা কি ঈর্ষা অনুভব করে?

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

প্রাণীরা কি ঈর্ষা অনুভব করে?

যাদের পোষা প্রাণী রয়েছে সম্ভবত তারা প্রত্যেকেই দাবি করবে যে প্রাণীরা ঈর্ষা অনুভব করে । কারণ, বিড়ালের মনোযোগের চাহিদা যেন বাসার নতুন শিশুটির আগমনের সঙ্গেই শুরু হয় আবার আপনার পোষা কুকুর অন্যদের সামনে যেমন আচরণ করে, আপনার জীবনের সেই উল্লেখযোগ্য নতুন মানুষটির সামনে তার আচরণ বদলে যায়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন গবেষণার মাধ্যমে প্রাণীদের আবেগ শনাক্ত করতে। বিশেষত প্রাণীদের মৌলিক অনুভূতি এবং মানুষের সংস্পর্শ হতে প্রাপ্ত প্রবণতাগুলো পৃথক করা কষ্টসাধ্য। তবে গবেষণা হতে এই ধারণা পাওয়া গেছে যে অন্তত ‘ঈর্ষা’ একটি আদিম অনুভূতি যা মানুষ এবং কিছু প্রাণী, বিশেষ করে কুকুর ও বনমানুষ প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান। একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে যদিও ‘ঈর্ষা’ এবং ‘হিংসা’ শব্দগুলো অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, মনোবিজ্ঞানীরা এদের খুবই ভিন্ন দুটি অনুভূতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। হিংসা একটি দ্বৈত সত্তার আবেগ যা অনুভূত হয় যখন আমাদের কোন কিছুর ঘাটতি থাকে যা অন্য কেউ ভোগ করতে পারছে, হতে পারে তা কোন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বা কোন বস্তু। অন্যদিকে, ঈর্ষা অনুভব করার জন্য প্রয়োজন একটি সামাজিক ত্রিভুজ সম্পর্ক, যেখানে কেউ অথবা কোন কিছু একটি বিশেষ বন্ধনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে হয়। একজন মানুষ বা প্রাণীর ঈর্ষা অনুভব করার জন্য তাদের চেতনামূলক ক্ষমতা এমন স্তরের হতে হবে যার মাধ্যমে তারা একটি সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে এবং এবং সম্পর্কটির জন্য সম্ভাব্য ক্ষতিকর কিছু নির্ণয় করতে পারেÑ যা কিছু প্রাণীর জন্য সন্দেহাতীতভাবে একটি জটিল বিষয়। ঈর্ষা সংক্রান্ত অধিকাংশ গবেষণাতত্ত্ব যৌন ও প্রেমের সম্পর্কগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে, তবে স্বভাবতই ঈর্ষান্বিত হওয়ার বিষয়টি অন্যান্য সম্পর্কেও ঘটতে পারে, যেমন বন্ধু, পরিবার এবং সহকর্মীদের মাঝে। এমনকি গবেষণা করে দেখা গেছে ৬ মাস বয়সী শিশুরাও ঈর্ষার প্রকাশ ঘটায় যখন তাদের মায়েদের অন্য শিশুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে বাস্তবসদৃশ পুতুল ছিল। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে ঈর্ষা একটি জন্মগত আবেগ, যা বিকশিত হয় যে কোন ধরনের সামাজিক সম্পর্ককে অনধিকার প্রবেশকারীদের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য এবং ধারণা করা যায় কিছু প্রজাতির সামাজিক প্রাণীর মধ্যেও এর বিকাশ ঘটতে পারে। ২০১৪ সালে স্যান ডিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা শিশুদের নিয়ে করা পরীক্ষাটি পরিবর্তন করে মানুষের প্রিয় বন্ধুর ওপর পরিচালনা করে। তারা দেখে যে কুকুরগুলো অনেক বেশি ঈর্ষান্বিত হয়ে পরে যখন তাদের মালিকরা অন্য একটি নকল কুকুরের সংস্পর্শে যায়, তাদের আদর করে এবং সত্যিকার কুকুরের ন্যায় তাদের সঙ্গে আচরণ করে, একই ব্যবহার গ্লাস বা বইয়ের সঙ্গে করলে কুকুরগুলো তেমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যক কুকুর তাদের মালিক এবং নকল কুকুরের মাঝে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, এবং এক-চতুর্থাংশ কুকুর নকল কুকুরটিকে আক্রমণও করে। যে সকল কুকুর ঈর্ষা প্রদর্শন করেনি, গবেষকরা সন্দেহ করছে যে সেগুলো হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে খেলনা প্রাণীগুলো জীবন্ত কুকুর ছিল না, অথবা কুকুরগুলোর তাদের মালিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। গবেষকরা এক প্রজাতির একগামী টিটি বানরের মধ্যেও ঈর্ষান্বিত হওয়ার প্রবণতা শনাক্ত করেছেন এবং তারা এই প্রাণীগুলো ব্যবহার করছেন এই শক্তিশালী অনুভূতিটির স্নায়ুবিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে। সঙ্গী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি প্রতিক্রিয়ায় পুরুষ টিটি বানর আক্রমণাত্মক আচরণ করে, তাদের সঙ্গী ও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে নিজেদের স্থাপন করে, মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গীদের শারীরিকভাবে বাধা দান করে পরপুরুষদের দিকে এগোতে। ফ্রন্টিয়ার্স ইন ইকোলজি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীর এ বছরের সংখ্যায় প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী গবেষকরা পুরুষ টিটি বানরদের ৩০ মিনিট ধরে দেখায় যে তাদের সঙ্গীরা অপরিচিত পুরুষের সংস্পর্শে যাচ্ছে, এরপর একই সময় ধরে অপরিচিত নারী বানরদের অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেখায়। তাদের সঙ্গীদের পর্যবেক্ষণ করার সময় বানরদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা তাদের সঙ্গী-সম্পর্কিত আক্রমণাত্মক ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবণতার সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি তাদের মধ্যে কোর্টিসল হরমোনের ক্ষরণ হয়, যা সামাজিক চাপ ইঙ্গিত করে। উপরন্তু, মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা যায় তাদের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়, যেমন মানুষের যে অংশ সামাজিকতা বর্জন (সিঙ্গুলেট কর্টেক্স) ও আক্রমণাত্মক আচরণ (ল্যাটেরাল সেপ্টাম) নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যাদের বাড়িতে বিভিন্ন পোষা প্রাণী রয়েছে, তদের অধিকাংশ জানায় এ সকল গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গত আচরণ তাদের ঈর্ষান্বিত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে, এদের মধ্যে ঘোড়া, পাখি ও বিড়ালও রয়েছে। কুকুর এবং বনমানুষের বাইরে আরও বিভিন্ন প্রাণীর সামাজিক আবেগ অনুভূতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা উদ্ঘাটন করতে পারে যে ঈর্ষা যতটা না আবির্ভূত হয় তার থেকে অনেক বেশি ব্যাপক। সূত্র : লাইফ সায়েন্স
×