ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুশান্ত মজুমদার

শওকত আলীর গল্প উত্তরের চালচিত্র

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

শওকত আলীর গল্প উত্তরের চালচিত্র

‘কিষানের একটা জীবনই কি কম, কহ? ... কিষানের জীবনে কত কথা থাকে’ এবং ‘একটি-দুটি করে লোক দেখা গেল এক সময় বড় সড়কের ওপর। কৌতূহল না সমবেদনার কারণে তারা একে একে এসে পৌঁছাচ্ছিল বোঝা মুশকিল। তবে লোকগুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হচ্ছিল তার প্রমাণ তারা ক্রমেই কাছাকাছি জড়ো হচ্ছিল এবং জড়ো হয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল’Ñ এই উদ্ধৃতাংশ শওকত আলীর ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পের। কিষান জীবনের কত কথা, কিষানের আগমন, তাদের আন্দোলন, জড়ো হয়ে এগিয়ে আসার তৎপরতা নিয়ে শওকত আলীর উত্তরের জনপদ কেন্দ্রে রেখে তাঁর গল্পের বিষয়। এই কিষানরা উত্তরবাংলার মানুষ হলেও পীড়িত জীবন নিয়ে সারাদেশের কিষান সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। শওকত আলীর গল্প মানে ছেঁড়াখোঁড়া উত্তরের লোকালয়, ‘যেখানে ধূসর কুয়াশার ভেতর দিয়ে চুঁয়ে পড়ে জ্যোৎস্না’, ওই ‘কুয়াশার মধ্যে অনাথ শিশুর মতো শুয়ে থাকে অন্ধকার’, স্তূপীকৃত খড় জ্বালিয়ে শীতের চাবুক থেকে রেহাই খোঁজে ছায়া শরীর, আসমান আর দিগন্ত একাকার করে উঠে আসে কৃষ্ণ মেঘ। এসব তন্ন তন্ন করে দেখার সজ্ঞান কথাশিল্পী শওকত আলী। মেহনতী কিষান- যাদের কোন ভবিষ্যত নেই, এই তারা শ্রমে, প্রাপ্তিতে প্রচ- মার খাওয়া, বঞ্চিত অথচ এই মানুষ মাটি আবাদ করে ফসল ফলায়, ফসল লালন করে কিন্তু ফসল তুলে দিয়ে আসে মহাজনের গোলায়। চামড়া ফাটানো হাড়ছেঁদা তুমুল শীতের রাতে কিষানের মহাজনের ফসলও পাহারা দিতে হয়, বিনিময়ে সে হারায় স্বাস্থ্য, আয়ু ও সুখ। উত্তর বাংলার কিষানের বিস্তারিত জীবনকথা নিয়ে এত গল্প শওকত আলীর মতো কোন কথাশিল্পীই লেখেননি। উত্তরের জনগোষ্ঠী, তাদের প্রাত্যহিক জীবন-সংসারের চালচিত্র জল-হাওয়া কথাসাহিত্যে রূপ দেয়া এবং তা ব্যাপক পাঠক সীমপে উপস্থিত করার কৃতিত্বের সিংহভাগ শওকত আলীর প্রাপ্য। হাড্ডিসার, হাঁটুভাঙ্গা মানুষ নিয়ে তাঁর কারবার, অথচ গল্পের মানুষ জীবন-জীবিকায় উপর্যুপরি মার খেতে খেতে বুক দিয়ে হেঁটে হলেও দাঁড়াতে প্রয়াস নেয়Ñ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে না। রুখে দাঁড়ানো মানুষের স্বাভাবের অন্তর্গত- জেগে ওঠা মানুষ সংঘবদ্ধ হয় এবং মহাজনের ঘরে আগুন দিয়ে নিপীড়কের বিনাশ ঘটায়। কেবল ব্যর্থতার কাহিনী রচনা করে শওকত আলী জীবনকে নঞর্থক করে তোলেননি জীবনে জীবন যোগ করে মানুষের রূপও গল্পে দাখিল করেন। জীবন যে হারিয়ে ফুরিয়ে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নিÑএখনও তার অবশিষ্ট আছে এবং সমুদয় প্রাপ্য আদায় সম্ভব সমষ্টির ঐক্যবদ্ধে তাই তাঁর গল্পের মর্মার্থ। শেষাবধি ইতিবাচক জীবনের গাঁথাই শওকত আলীর গল্পের উদ্দিষ্ট। কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’, ‘অপেক্ষা’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘ উত্তরের খেপ’, ‘জননী ও জাতিকা।’ গল্পগ্রন্থ ‘উন্মূলবাসনা’, ‘লেলিহানসাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’ ইত্যাদি। গল্প রচনায় তাঁর সাফল্য ষাটের দশকে। আরও আগে তিনি সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় হলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প ষাটেই লেখা। তখন গল্প সাহিত্যের পালে লেগেছে উপযুক্ত বাতাস। গল্প লেখকরা বহুস্তরা জীবনের বিভিন্ন অর্থ খোঁজার অভিপ্রায়ে প্রবেশ করেন জীবন ও সমাজের তলদেশে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার তাবত বৈষম্য, গৃহীত অন্যান্য ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ-সমালোচনা সহযোগে লেখকরা উর্বর করে তোলেন ছোটগল্পের ভূমি। সেই সময় গ্রাম নিয়ে গল্প লেখার প্রাচুর্য। শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক গ্রামবাংলার জনজীবন ছোটগল্পে চিত্রিত করেছেন; আর তা সম্প্রসারিত করেন শওকত আলী। শোষণের বিবিধ কৌশল এবং শোষিতের নিরুপায় অসহায় আতর্নাদ তাঁর গল্পে বিস্তারিত। দেশ ভাগের পরবর্তীকালের ছোটগল্পে সমাজের অসাম্য, অনাচার, দুষ্টমতি মানুষের পাপাচার নিয়ে দুর্নীতির চিত্র থাকলেও তা কেবল অচঞ্চল স্থির চিত্রই থাকে। মানুষকে চলিষ্ণু মনে হয় না। শওকত আলীর গ্রাম ও মানুষ পাঠকের সামনে যাতায়াত করে, মন ঘেরাও করে এবং মানুষের মর্যাদা দাবি করে। এমন কি শওকত আলীর গল্পের প্রকৃতিও জীবন্ত। কখনও কখনও প্রকৃতি শত্রুতা করে। যে জনপদের যে মানুষের জীবন তাঁর গল্পের বিষয় অনুরূপ নির্দয় প্রকৃতির সাক্ষাত সেখানে আমরা পাই। প্রকৃতি মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ গল্পের পরিপ্রেক্ষিতের অনুগামী হয়েছে প্রকৃতি। গল্পের সঙ্গে প্রকৃতি একাকার হয়ে থাকে। শওকত আলী গল্পে প্রকৃতি চাপিয়ে দেননি বা কোথাও থেকে তুলে এনে সেট করে দেননি। প্রকৃতি থেকে মানুষ যেন বেরিয়ে আসে- উত্তর বাংলার প্রকৃতির মতো গল্পের মানুষ রুক্ষ। রোদে পোড়া, শীতজর্জর, বৃষ্টিতে ভেজা ন্যাতানো। তাঁর গল্পের মানুষ ও প্রকৃতিকে তাই ছিঁড়ে আলাদা করা যায় না। প্রকৃতির মতো শওকত আলীর গল্পের মানুষ আমাদের চেনা-জানা। বড় বড় ডায়ালগ দিয়ে তাঁরা বক্তৃতা করে না, দার্শনিক বুলিও আওড়ায় না, পূর্ব থেকে বারুদে ভরপুর হয়ে শ্রেণীক্রোধের নিকেশও চুকায় না। বরং মার খায় মহাজনের হাতে, সামন্ত এবং পক্ষপাতমূলক সমাজ ব্যববস্থার কাছে। এরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার সংগঠিত হয়। সংগঠিত মানুষ তখন সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়। এদিক বিবেচনা করলে উত্তর বাংলার জনপদের বছরের পর বছর মানুষের যে জীবনযাপন সেই সব আখ্যান শওকত আলীর গল্প। কিন্তু কাহিনী কেবল গল্প নয়। শিল্পম-িত, আবেদনগ্রাহ্য হয়ে গল্পের পাঠক মন ধরে সজোরে নাড়া দেয়, তাপ বিস্তার করে। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পের রমজান আলী অহর্নিশ ক্রন্দনরত বৃদ্ধা মাকে কোনভাবে নিবৃত্ত করতে না পেরে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু মায়ের মরা মুখ কল্পনা করতে তার খারাপ লাগে। সবাই মরেছে। কেবল সে মুমূর্ষুূ ক্ষুধার্ত মাকে আগলে আছে অথচ ঘরে খুদ-কুঁড়ো নেই। শেষে রমজান আলী চোরের সর্দার কলিমউদ্দিনের সাগরেদি নেয়া মনস্থ করে। রোজগার হলে মা তাহলে অমন করে কাঁদবে না। কিন্তু ঘরে ফিরে সে টের পায় মার তার কাঁদছে না। রমজান আলী তখন চিৎকার করে ‘মা, তুই চুপ করে আছিস ক্যানে, মা আর কান্দিস না ক্যানে।’ ‘নবজাতক’ গল্পের মন্তাজ ধান মাপার পর ভাগাভাগি নিয়ে মহাজনের পোষ্য গু-াদের হাতে প্রহৃত হয়। তার পিতা হাসন আলীর মনে পড়ে ধান নিয়ে আধিয়ার কিষানের লড়াইয়ের স্মৃতি। এদিকে অনেক টানা হেঁচড়া, কষ্ট-যন্ত্রণার পর গরু একটা বাচ্চা প্রসব করেছে। গল্প এখানে এসে প্রতীকধর্মী হয়ে ওঠে। আগুনের আলোয় দেখা যায় বাচ্চাটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে রক্তের আর কান্নার স্রোত জেগে ওঠে মন্তাজ আলীর চোখের সামনে। ‘লেলিহানসাধ’ গল্পে দুই কিষান মনোহর ও সবদর আলী তীব্র শীতের কষ্ট থেকে বাঁচতে রাতে আগুনের ব্যবস্থার জন্য মহাজনকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। দুই উজবুক দিনিয়ারের ডাক শুনে চৌধুরী যখন বাইরে বেরুলো তখন তার হাতে গরু তাড়ানোর লাঠি। শটাশট সে মারতে থাকে দু’জনকে। মহাজন আবার ঘরে ফিরে গেলে দুই কিষান খড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। শেকল তুলে দেয় মহাজনের দরজায়। শওকত আলীর ‘আর মা কান্দে না’-এর রমজান আলী বেকার, গ্রামে কাজ নেই- তার করার কিছু নেই। এখানে সে একা। ‘নবজাতক’ গল্পের চরিত্রের সামনে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি আছে, কিন্তু ‘বড় ডর করে এখন, কুনো আধিয়ার কিষান আর উ কথা কহে না’ বলে, মহাজনের মার হজম করে। এখানে একজন জোয়ান, একজন বৃদ্ধ। ‘লেলিহানসাধ’ গল্পে দুই জোয়ান কিষান মার খায় এবং মার দেয়। গল্প তিনটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শওকত আলীর গল্পের চরিত্রের ধারাবাহিকতা এবং ক্রমবিকাশ। ভয়কে জয় করছে চরিত্র। কোন কিছু করতে না পারার বরফ তারা ভেঙ্গে ফেলেছে-পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরই প্রভাব পড়েছে শওকত আলীর পরবর্তী গল্পে। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মহাজনসহ তার নৌকা, কিন্তু পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ‘ভবনদী’ গল্পের নসরউদ্দিনের নৌকার কাছিটা গাছের গুঁড়িতে পেঁচিয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তার কাছে বড় হয়ে ওঠা- ‘সংসারে কত দুঃখ-হায়, আমার বউয়ের বুকে দুধ নাইগো। মেয়েটা ভয়ানক কান্দে।’ ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পে মনোহরের সুন্দরী মেয়ে নয়নতারাকে মহাজনের পোষা মস্তানরা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। ঘটনা শুনে সহানুভূতিশীল পাড়াÑপ্রতিবেশীরা বড় সড়কের ওপর জড়ো হয়। এই জটলার মুখে পড়ে বাজার থেকে ফেরা মহাজন। মন ভোলানোর কথা বলে সে মানুষের ক্রোধ কিছুতেই প্রশমিত করতে পারে না। শেষে মহাজন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে। তাকে ধাওয়া করে পেছন ছুটতে থাকে সব মানুষ। ‘কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ’ গল্পে বৃদ্ধ সাঁওতাল কপিলদাস বসত উচ্ছেদের বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদ করেÑ ‘মহাজন বসত উঠায় দিবা চাহিলেই কি হোবে, ক্যান হামার কমরত জোর নাই।’ বুড়ো বয়সে সে তীর তুলে নিলে কিশোরকাল ফিরে পায়। জীবনে প্রথম নিশানা ভেদ করার খুশি আর একবার শেষ জীবনে এসে সে উপলব্ধি করে। শওকত আলীর গল্পে এসব মানুষ একক বা সমষ্টিগতভাবে প্রতিবাদী। আশি দশকের মাঝামাঝি শওকত আলী লেখেন ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পটি। পৌরাণিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সমকালীন জীবন একীভূত করে তিনি মহাজন ও মজুরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। এই মজুর গোসাপ ধরা সাঁওতাল সাপুড়ে গুপীনাথ। তার কবলে পড়েছে সীমান্তের ওপার থেকে আশা চোরচালানী লক্ষ্মীকান্ত। বর্ডারের গোলমালে যেতে না পেরে সে রাতে হাঙ্গামার ভয়ে পলাতক এপারের আড়তদার কসিমুদ্দিনের আড়তে আশ্রয় নেয়। সেখানে এসে উপস্থিত হয় এই গুপীনাথ। সাপ ও গুপীনাথের ভয়ে লক্ষ্মীকান্ত পুরনো হিসাব মিটিয়ে দিতে চায়। এদিকে লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায় আড়তের ঘর। লক্ষ্মীকান্ত একবার সরে বসতে চাইল। আর তাতেই ভয়ানক শব্দে ফুঁসে উঠল একটা সাপ। পুরনো হিসাব বুঝে নিতে গুপীনাথ প্রথম থেকে বেপরোয়া। কেবল জীবন-জীবিকার কারণে তার চরিত্র রুক্ষ নয়, মহাজনকে মুঠোয় পেয়ে প্রতিশোধ নিতেও সে তৎপর। শওকত আলীর গল্পের এই গুপীনাথ ভয়কাতুরে দোদুল্যমান নয়। অন্যান্য চরিত্রে যে সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা, পিছুটান আছে তা গুপীনাথ চরিত্রে নেই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে প্রকাশিত হয় শওকত আলীর গল্পগ্রন্থ ‘উন্মুল বাসনা।’ স্বাধীনতা-পরবর্তী যে সমাজসচেতন শওকত আলীর পরিচয় তাঁর সাহিত্যে পাই তা পূর্ব লিখিত গল্পে অনুপস্থিত। এ গ্রন্থের গল্পসমূহে মানুষের জৈবিক চাহিদা, তাদের রিরংসাবৃত্তির সঙ্গে নারীকে পাওয়ার জন্য পুরুষের পরস্পর সন্দেহ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত চিত্রায়িত হয়েছে। ‘রঙ্গিনী’ গল্পের দুই পুরুষ একই নারীকে আকাক্সক্ষা করে। ড্রাইভার ও নটবর জ্ঞানশূন্য ক্রোধে মারামারিতে লিপ্ত হয়। গল্প থেকে আমরা জানতে পারি : ‘সব নেশার চাইতে বড় নেশা হলো এই মেয়ে মানুষ। যখন পুরুষকে এই নেশা টানে তখন বিচার বুদ্ধি বিবেচনার কোন কিছু করার শক্তি থাকে না।’ উন্মুল বাসনার বাকিগুলো ‘ফাগুয়ার পর’, ‘পুশনা’, ‘তৃতীয় রাত্রি’, ‘বিকলাঙ্গ পিপাসা,’ ‘ডাইন’-এ উঠে এসেছে নরনারীর সংযমশূন্য নিবিড় যৌনকামনা। সাঁওতাল জীবনাচরণ থেকে নিম্নবর্গের বেসামাল নেশা, আমোদ, চিত্তচাঞ্চল্য, মানবেতর জীবনযাপনের মধ্যে উপচে পড়া শরীরই দাপট দেখায়। শওকত আলীর প্রতিটি গল্পে রয়েছে নারী। কখনও নারী গল্পে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত, কখনও কাহিনী সূত্রে পরোক্ষে এসেছে। তবে যেসব নারী গল্পে সক্রিয় তাঁরা অসহায়, বঞ্চিতা, নিরুপায় এবং কখনও মালিকের ভোগের পণ্য। নারী জীবনের এমন দুর্গতি শওকত আলী গল্পে এনেছেন যেন তারা উপযুক্ত সহানুভূতি পেতে পারে। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পের বৃদ্ধা মাকে লেখক কয়েকটি আঁচড়ে বাস্তবগ্রাহ্য করে তুলেছেন। ‘ডাকিনী’ গল্পে পুলিশ রাস্তার ছেলেপেলে ধরে ট্রাকে উঠাতে গেলে রাস্তায় বসে থাকা মেয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দেয়। গল্পে মাতৃহৃদয়ের দাবি পাঠক উপলব্ধি করতে পারেন। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে মহাজনদের একটি করে নারী আছে, যারা কোন না কোন কিষানের বউ। নিরন্ন কিষানের দারিদ্র্য বাধ্য করেছে কিষান বউদের মহাজনদের শয্যাসঙ্গিনী হতে। বিত্ত-বৈভবের গরমে সামন্ত প্রভুূ চরিত্রহীন হয়ে থাকে। তাদের মেয়ে মানুষ পাওয়ার খিদে শওকত আলী তুলে এনেছেন। গল্পের সংঘটিত ঘটনার সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতির আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। আনন্দ-ফুর্তির ঘটনা ঘটতে থাকে সব রাতে। রাতের কারণে মেয়ে মানুষ নিয়ে পুরুষের অসামাজিক অবৈধ ভোগ-লিপ্সা শওকত আলীর গল্পে ব্যাপক জায়গা পেয়েছে। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পে জানতে পাইÑ বুড়ো মহাজনের ভারি পছন্দ কলিমউদ্দিনের বউকে। কলিমউদ্দিনের বউকে রাতে পাটক্ষেতের আল ধরে লণ্ঠনের আলো দুলিয়ে যেতে দেখা যায়। ‘নবজাতক’ গল্পে ছোট মহাজন নিজেই মেয়ে মানুষের গল্প বলে- ‘সার্কাস পার্টির তিনটা মেয়ে মানুষ যা ছিল না। আহ হা; দেখিলে মন কহে খালি দেখতে থাক। গতরত একনা কাপড় নাই বাহে।’ ‘লেলিহানসাধ’ গল্পেও কাসেমালির বউকে বুকে নিয়ে মহাজন ঘুমিয়ে থাকে। ‘বিদায় দে মা’ গল্পের মহাজন তো অনেকদিন নারীসঙ্গ বঞ্চিত। তার ভাবনাÑ ‘স্ত্রী রোগশয্যায় থাকলে কি সেই সঙ্গ পুরুষের ভাল লাগে।’ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে একটা যুবতী সে বিয়ে করে। ‘অন্ধকারের গান’ গল্পের কসিমুদ্দিনের চুরির দায়ে জেল হয়। এই সুযোগে তার সুন্দরী বউকে হাতিয়ে আনে মহাজন। নুরবানু বলে- ‘মহাজনের নফর থোক কামড়ায় কামড়ায় খায় একবার, একবার খায় মহাজনের ব্যাটা, ফের একবার খায় মহাজন নিজে। কিন্তু মুই কিছু কহো না।’ নুরবানুর এই জবানি আর্তনাদ হয়ে পাঠককে কবলিত করে। গল্পের উত্তর বাংলার আবহ পরিবেশ রচনায় শওকত আলীর হাত অসাধারণ। তবে একটি গল্পের সঙ্গে কখনও আরেকটি গল্পের সাযুজ্য আছে। এক রাত, এক শীত, বৃষ্টি এবং কান্দরের বর্ণনা গল্পে ঘুরে ফিরে আসে। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পে : ‘অন্ধকার চারদিকে থৈ থৈ করে। মনে হয় বাতাসে অন্ধকার পাক খাচ্ছে, ফুলছে আর চারদিকে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেখো, দক্ষিণ দেখো, আসমানে তাকাও শুধু কালো। থেকে থেকে কালো মেঘের পি-গুলো একদিক থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে আরেক দিকে। ঠা-া হাওয়ার ঝাপটা এসে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।’ এই বর্ণনার সঙ্গে মিল আছে ‘লেলিহানসাধ’ গল্পের প্রকৃতিরÑ‘খোলা কান্দরে হাওয়ার ঝাপটা ভীষণ আছাড় খাচ্ছে। উত্তর থেকে বাতাস শব্দ করে ছুটে আসছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উথাল-পাতাল অন্ধকারটা দেখে নিল দুজনে। তারপর পা বাড়াল। কিন্তু কোথায়? তখনই শুরু হলো বেদম বৃষ্টি। ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পেরও আকাশ-বাতাস-বৃষ্টির বর্ণনা অনুরূপ : ‘আসমানের লীলা বোঝা ভার। এই বাতাস বন্ধ, গুমোট ভাব, যেন চেপে আসছে বুকের ওপর ভারি বোঝার মতোÑ তারপর এই আবার দেখ, দেখতে দেখতে কোন দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে দিল, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটে উঠল বাতাসের গায়ে। শেষে মেঘ ডাক ছেড়ে বৃষ্টি ঢালতে শুরু করে দিল।’ শীতের প্রকোপ এবং তীব্র শীতে শায়েস্তা হওয়া কামলা-কিষানের দুরবস্থা একই। মনে হতে পারে, এটা বুঝি লেখকের পুনরাবৃত্তির প্রবণতা। প্রকৃত পক্ষে শওকত আলী তার চেনাজানা উত্তর বাংলার পরিপ্রেক্ষিত, বিরাজমান একই বাস্তবতা, যথার্থ ইন্দ্রিয়গোচর সত্য গল্পে ধরেছেন। এ কারণে দৃশ্যমান বিভিন্ন অংশের নৈকট্যের প্রতিফলন তাঁর গল্পে দেখা যায়। শওকত আলীর গল্পের গদ্য সরল, সর্বত্র অলঙ্কারশূন্য নয়। অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে তিনি কাহিনী লিখে যেতে পারেন। জয়-পরাজয়, আলো-অন্ধকার, উত্থান-পতন মিলিয়ে তিনি যে জীবন চিত্রিত করেন সে জীবন প্রতিদিনের বাঁচার জন্য লড়াই করে, প্রতিদিন সে জীবন নিঃশেষিত হচ্ছেÑ সেই রুক্ষ, অশ্রান্ত ও অশান্তিময়, সুখবঞ্চিত শাঁসহীন জীবন রূপায়ণের গল্পভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন। জীবন ও সমাজের যে অংশ ধূসর, ধূলিমলিন, নিষ্প্রভ, জলহীন, ফাটলপূর্ণ তার যথাযথ প্রকাশে শওকত আলী দক্ষ। ছোটগল্প রচনায় শওকত আলীর কৃতিত্ব উজ্জ্বল ও আয়ুষ্মান। জলো, অসার গল্পচর্চার বিপরীতে সমাজবাস্তবতার গল্প ধারাকে যাঁরা বেগবান এবং শক্তিশালী করেছেন তাদের অন্যতম শওকত আলী। দেশ বিভাগের পর খ-িত, ভেদবুদ্ধির শিল্পচর্চা মোকাবেলা করে দুর্বল ছোটগল্পকে সবল করে তোলার বিষয়ে তাঁর শ্রম দীপ্তিমান। বাংলা ভাষাভাষী এই ভুখ-ে আজ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কথাসাহিত্য, বিশেষত গল্পের যে শক্তিশালী ধারা গড়ে উঠেছে, যাঁদের নিরলস চর্চার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে তাঁদের একজন শওকত আলী। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উন্মুল বাসনা’র গল্পসমূহের যে প্রধান প্রবণতা জৈবিক প্রবৃত্তি তা থেকে সরে এসে তিনি সমাজ ও মানুষ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব গল্পে মূর্ত করে নিশ্চিত করেছেন তাঁর ক্রম-উত্তরণ। বানোয়াট কেচ্ছা ফাঁদা অস্বীকার করে তিনি গল্পে ধারণ করেছেন মানুষ, জায়গা-জমি এবং মানুষের তৃষ্ণা। মানুষের এই তৃষ্ণা আর কিছু নয়Ñ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রবল স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা।
×