ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ হাজার কবি- অন্য রকম উৎসব নীলফামারীতে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

১৮ হাজার কবি- অন্য রকম উৎসব নীলফামারীতে

মোরসালিন মিজান/ তাহমিন হক ববি, নীলফামারী থেকে ॥ দেশের কোন একটি জেলায় ১৮ হাজার কবির বাস! এমন কথা শুনে যে কেউ চোখ কপালে তুলবেন। হা হা করে হেসে উঠবেন কেউ কেউ। তবে ঘটনা সত্য। নীলফামারীতে এসে নিজ চোখে দেখার পর বলতেই হচ্ছে, ঘটনা সত্য। বড় নন। বুড়ো নন। সবাই কচিকাঁচা। স্কুলে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। সেইসঙ্গে চলছে কবিতা চর্চা। লেখার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত নিজের কল্পনাগুলোকে সাজাচ্ছে তারা। দেশ মাটি মায়ের কথা বলছে। গৌরব করতে শিখছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আর ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে মৌলবাদ জঙ্গীবাদ। কবিতাকে আশ্রয় করে অভূতপূর্ব এই জাগরণের সূচনা করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। ‘ভিশন ২০২১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়েছিলেন কয়েকশ’ তরুণ। তারা উদ্যোগী হয়ে ছড়া ও কবিতা লিখন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবিতা লিখেছিল বিপুলসংখ্যক ছেলে মেয়ে। সে বছরই প্রথম জানা যায়, নীলফামারীতে কবি সংখ্যা ১৬ হাজার! এবার ২০১৮ সালে সংখ্যাটি বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৪শ’ ২১। লিখেছে বটে। লেখাগুলো শেষতক কবিতা বা ছড়া হয়ে উঠল কী? ছিল খতিয়ে দেখার ব্যবস্থাও! যে সে বিচারক নয়, রাজধানী ঢাকার বড় বড় কবি ছড়াকার ও সাহিত্য সম্পাদকরা এসব কবিতা পড়েছেন। যাচাই-বাছাই করেছেন। এ পর্যায়ে সংখ্যাটা কিছু কমে গেলেও, ৪১৪ জনের নিচে নামেনি! প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ওঠে আসা এই কবিদের প্রত্যেককে পুরস্কৃত করা হলো বৃহস্পতিবার। তাদের ছড়া কবিতা নিয়ে বিশাল বই প্রকাশিত প্রকাশিত হয়েছে। সে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হলো। ছিল আবৃত্তি গানসহ নানা আয়োজন। শহর ঢাকায় এ ধরনের আয়োজনে দর্শক শ্রোতা হয়ে কতজন আসেন? দেড়শ থেকে দুইশ? পাঁচশ? আর নীলফামারীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ! হ্যাঁ, হিসাব করেই বলা। বিশাল খোলা চত্বরে শুধু চেয়ার পাতা হয়েছিল ১২ হাজার। বাকিরা দাঁড়িয়ে ছিলেন এখানে ওখানে। এমনকি পাশের রাস্তা, বাড়ির ছাদ, গাছের মগডালে ঝুলে ছিলেন বহু মানুষ। কবিতা ঘিরে এত কৌতূহল, এমন উৎসব সত্যি অবিশ্বাস্য! আয়োজনের শুরু হয় বেলা পৌনে ২টায়। তারও অনেক আগে থেকে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে শুরু করে কবিরা। ক্ষুদে কবিদের অভিভাবকরা এসেছিলেন। রাজনীতির মানুষজনও এদিন মজেছিলেন কবি ও কবিতায়। আর ঢাকা থেকে এসেছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। হ্যাঁ, নীলফামারী সদর তাঁর নির্বাচনী এলাকা। এখানে মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে অহর্নিশ লড়তে হচ্ছে তাঁকে। আর এ লড়াইয়ে তিনি হাতিয়ার করেছেন সংস্কৃতিকেই। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সামনে থেকে তারা কাজ করলেও, নেপথ্যে ছায়া হয়ে আছেন আসাদুজ্জামান নূর। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটি তার সচেতন প্রয়াস। ব্যক্তিগত উদ্যোগ। স্থানীয় আয়োজন হলেও উৎসবের সঙ্গে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে ঢাকা। এদিন রাজধানী থেকে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন প্রসিদ্ধ কবি ও ছড়াকাররা। কবি আখতার হোসেন, সাজ্জাদ শরিফ, ছড়াকার আলম তালুকদার, আসলাম সানী, সুজন বড়ুয়ার মতো প্রতিথযশা ব্যক্তিরা উৎসবে যোগ দেন। আসেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোশারফ করিম। সকলের উপস্থিতে জাতীয় চেহারা পায় উৎসব। দারুণ জমে ওঠে। প্রথমেই ছিল জাতীয় সঙ্গীত। সব বয়সী মানুষ হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে গানÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। এর পর বেলুন উড়িয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। ক্ষুদে কবিদের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত বইয়েরও মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। এ সময় বইয়ের পাতা উল্টে দেখা যায়, আনন্দ নিকেতনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র রাকিবুল হাসান তার মাকে নিয়ে ছড়া লিখেছে। লেখাটি এরকমÑ ‘মা যে আমার পৃথিবীতে শান্তি-সুখের বাসা,/ মাকে ছাড়া মেটেনা যে মনের আশা...।’ আল হেলাল একাডেমির দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র রিফায়া নানজিবা লিখেছে, ‘আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ তার নাম, লাল সবুজের এই দেশটির অনেক অনেক দাম...। ইটাখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী লিখেছে বঙ্গবন্ধুর কথা। তার ভাষায়, ‘এই দেশ এই প্রিয় মাটি ঘিরে শত নদী বহমান,/ হাজার যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান...। অন্নদা শঙ্কর থেকে ধার করা হলেও, মন্দ লাগে না তার এই প্রয়াস। এভাবেই তো শুরু হয়। শুরুটা হবে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও তাই বললেন। তবে অল্প কথায়। হাজার হাজার কবিকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ছড়া কবিতা লিখে সবাই কবি হবে না। তবে নিজেকে গড়ে নেয়া জরুরী। এজন্য সুকুমার বৃত্তির চর্চা করতে হবে। পরে মঞ্চের বাইরেও কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মন্ত্রী বলেন, এটা আসলে মুভমেন্টের মতো। আন্দোলনের মতো। এ ধরনের আয়োজন সারা দেশে করা উচিত। এমন স্বপ্ন আছে বলেও জানান তিনি। অনুষ্ঠানে কবিতা বাছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত দৈনিক পত্রিকার প্রবীণ সাহিত্য সম্পাদক কবি আখতার হুসেন বলেন, কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খুব কড়াকড়ি করেছি আমরা। এর পরও এত কবিতা পাওয়া হয়েছে যে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। তাদের কবিতা পড়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। আজ তাদের সঙ্গে দেখা হলো। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শিশুরা অকৃত্তিম মানুষ। নিজের মনের কথা লেখে। তাদের সুযোগ করে দিন। উৎসব জমিয়ে রাখেন ঢাকার জনপ্রিয় ছড়াকাররা। শ্রোতারা দারুণ মুগ্ধ হয়ে ছড়া উপভোগ করেন। এদিন স্বরচিত ছড়া শোনান সুজন বড়ুয়া। তার ছড়ায় উৎসবেরই কথা ছিল। এই যেমন, ‘আজকে যেন নীলফামারী/ কবিতা আর ছড়ার বাড়ি/এক হয়েছে ছেলে উড়ো/ পিতা-মাতা শিষ্য-গুরু ..।’ বিপুল করতালির মধ্যে পাঠ শেষ করেন তিনি। বরাবরের মতোই আগ্রহ ছিল আলম তালুকদারের ছড়া শোনার জন্য। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যতক্ষণ কথা বলেন তার প্রায় পুরোটাই ছিল ছন্দে। ছড়া কেটে তিনি বলেন, ‘নীলফামারী নীলফামারী/ সালাম নিবেন এই আমার-ই।’ আসলাম সানীর কণ্ঠে ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের কথা। কবিতায় তিনি বলেন, ‘বাংলা আমার-বাঙালী আমি/মহকালের সন্তান/ মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস আমার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ উৎসবের চমৎকার এবং সহজ ব্যাখ্যা দেন কবি সাজ্জাদ শরিফ। শিশু সুলভ সারল্য নিয়ে তিনি বলেন, আমি জীবনে বহু কবিতা উৎসবে যোগ দিয়েছি। কিন্তু এই রকম আর একটিও উৎসব দেখিনি। পৃথিবীর সব কবিতা উৎসবকে এই উৎসব হার মানিয়ে দিয়েছে। সমবেত কবিদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, এই কোনায় কবি বসে আছে। ওই কোনায় কবি বসে আছে। এত কবির মুখোমুখি কোনদিন আমি হইনি। তিনি বলেন, কবিতা লিখতে গিয়ে তোমরা বাংলা ভাষাকে জেনেছ। নিজেকে জেনেছ। চারপাশের জগতটাকে জেনেছ। এভাবে তোমাদের মনে একটি মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই জয়যাত্রা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। এর বাইরে অভিনেতা মোশাররফ করিমকে নিয়ে বিশেষ আকর্ষণ ছিল ছেলে মেয়েদের মধ্যে। পরিবেশের প্রভাবেই কিনা কে জানে, এদিন জনপ্রিয় অভিনেতা কবিতা পাঠ করেন। এবং জানাতে ভুল করেন না যে, এটি তার নিজেরই লেখা কবিতা! পরে গানও গেয়ে শোনান তিনি। ছিল ম্যাজিকও। ঢাকা থেকে আসা দুই শিল্পী এদিন যাদু প্রদর্শন করেন। এভাবে মুখরিত ছিল পুরোটা সময়। আয়োজকদের পক্ষে ওয়াদুদ রহমান জানান, নীলফামারী সদর উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার যত কিন্ডার গার্টেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সবগুলোকেই প্রতিযোগিতার আওতায় আনা হয়। এবার মোট ৩৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছড়া কবিতা জমা দেয়। ভবিষ্যতেও প্রয়াসটি অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
×