ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের তীব্রতায় ধুম পড়েছে পুরনো গরম কাপড় কেনার

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

শীতের তীব্রতায় ধুম পড়েছে পুরনো গরম কাপড় কেনার

ওয়াজেদ হীরা ॥ রাজধানীসহ সারাদেশে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। দেশব্যাপী বয়ে যাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ। ইতোমধ্যেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ভেঙ্গেছে গত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ডও। সর্বত্রই শীতে জবুথবু অবস্থা। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে অল্প আয়ের মানুষগুলো। তাই উষ্ণতা পেতে তারা ঝুঁকেছেন পুরাতন কাপড়ের দিকে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুরাতন গরম কাপড়ের ব্যবসাটা বেশ জমজমাট। গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে পুরাতন কাপড় বিক্রির ধুম পড়েছে। বিশেষ করে এর ক্রেতা হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। বিভিন্ন রিক্সা বা ভ্যানচালক, বিভিন্ন শ্রমিকরা দেদারছে এই কাপড় কিনে নিজেদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন। পুরাতন কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন এই সেক্টরের ব্যবসায়ীরাও। বিকিকিনি আগের চেয়ে বৃদ্ধির কারণে বেশ স্বস্তিতে আছেন ব্যবসায়ীরা। শীতের এমন তীব্রতায় অত্যন্ত প্রয়োজন একটি গরম কাপড়। সচ্ছল মানুষের মধ্যে একটু ভালো বা নতুন ডিজাইনের পোশাক কেনা হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের অনেক ক্ষেত্রে তা হয় না। তাদের কাছে শীত উপশম করাই মুখ্য বিষয়। কাপড়ের মান বা দাম বলে কিছু নেই। যতো অল্পতে ভাল কাপড় তারা কিনতে পারে সেদিকেই ছুটে। সে হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতে বিক্রি হওয়া কাপড়ই তাদের প্রধান লক্ষ্য। ফুটপাতেরও অনেক ভাল কাপড় বিক্রি হলেও দাম নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে বেশি হওয়ার কারণে একটু সস্তায় তারা কিনে থাকেন পুরনো কাপড়। রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, বাংলামোটর, ফার্মগেট, নিউমার্কেটসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটের সামনে বা মোড়ে এই ধরনের কাপড় বিক্রি করতে দেখা গেছে। নগরীর বিভিন স্থানে পুরাতন কাপড়ের মধ্যে সোয়েটার, জ্যাকেট, কম্বল, গরম টুপি, ছোট ও বড়দের ব্লেজার, বিভিন্ন ডিজাইনের মাফলার বিক্রি করতে দেখা গেছে। দামও খুব সাধ্যের মধ্যে। বিভিন্ন ধরনের জ্যাকেট, ৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মোটা গেঞ্জি, সোয়েটার, চাদর পাওয়া যায় ১০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যেই। পল্টনে ভাসমান বিক্রেতা মামুন খোরশেদ বলেন, এই কাপড়গুলো কমদামে না বেচলে কাস্টমার পাওয়া যায় না। সব কাস্টমার আবার এসব কিনেও না বলেও জানান তিনি। নিউমার্কেটের ভাসমান বিক্রেতা খলিল বলেন, আমরা এসব অনেক সময় কিনে আনি। আবার বিভিন্ন বাসা থেকে সংগ্রহ করে ধুয়ে বিক্রি করি। বিভিন্ন হকার রিক্সাচালক যাদের আয় কম তারাই কিনে থাকে। এসব কাপড় পুরনো হলেও বেশ আরামদায়ক বলেও জানান তিনি। গোটা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাত জুড়ে গরম কাপড়ের ব্যবসা জমজমাট। নতুন নতুন বাহারি ডিজাইনের গরম কাপড়ের সাথে হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে পুরনো কাপড়ও। মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া গিয়ে কথা হয় ক্রেতা আবু বক্করের সাথে। মাত্র ১২০ টাকায় কিনেছেন একটি লম্বা জ্যাকেটের আদলে গরম কাপড়। তিনি বলেন, ‘সারাদিনে আমাদের রিক্সা চালিয়ে যা আয় হয় এই কাপড় কিনে এক দুই হাজার টাকা খরচ করতে চাই না। শীত কমানো দরকার তাই কিনলুম।’ একই ধরনের মন্তব্য আরেক ক্রেতা আব্দুস সোবাহান। পেশায় মাছ বিক্রেতা তিনি। বলেন ‘কাপড়ে আর ভাল মন্দ কি, সস্তা এর চেয়ে ভালো পাওয়া যায় না।’ ডাক বিভাগের সামনে বিক্রেতা জলিল বলেন, এই সব পোশাক কিনতে প্রতি পিস খরচ হয় মানভেদে ৫০ থেকে ১২০ টাকা। আমরা প্রতি কাপড়ে ২০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত লাভ করে থাকি। অনেক সময় পুরাতন কাপড় কিনে ওয়াশ করতে হয় বলেও জানান তিনি। শুধু পুরুষরাই নয় বিভিন্ন বাসায় খেটে খাওয়া কাজের মেয়ে, বুয়াদেরও ভরসা এই কাপড়। ছোট্ট শিশু জান্নাত। ভাল-মন্দ বুঝার বয়স হয়নি তার। মায়ের সাথে এসেছেন কারওয়ান বাজারে। মা আসিয়া বেগম নিজের জন্য এবং আদুরে কন্যার জন্য কিনলেন পোশাক। সব মিলিয়ে খরচ ২৭০ টাকা। অল্পতেই তুষ্ট তিনি। হাসিমাখা মুখে জানালেন বস্তিতে থাকি, সেখানেও ঘরভাড়া আছে। মাসে খাওয়া খরচ আছে। হিসেব করেইতো চলতে হয়। এমন হাজারো আসিয়া এই রাজধানীতে একটু অল্পতে কাপড় কিনতে মুখিয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও বসে থাকে এই পুরাতন কাপড়ের হাট। রাজধানী থেকে কাপড় কিনে তারা গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করে থাকেন। রাজধানীর কেরাণীগঞ্জ ও পুরান ঢাকায় এই পুরাতন কাপড়ের বড় বাজারও রয়েছে। এসব কাপড়ের আবার ক্রেতাও একটু ভিন্ন ধরনের। রাজধানীর চেয়ে বাহিরের বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এর চাহিদা বেশি থাকায় ঐ সময় জেলা থেকে পাইকাররা এসে কাপড় কিনে যায়। পুরান ঢাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তাদের ব্যবসাটা এখন একটু ভাল। গত কয়েকদিনে এই ব্যবসায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী হাজী আমজাদ বলেন, আমাদের কাপড়গুলো বিভিন্ন জেলায় পাঠাই। গত কয়েকদিনে বিক্রিও ভাল। পুরান ঢাকা ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পাইকারি বড় বাজার। রাজধানীর অনেক ব্যবসায়ীরাও যান সেখানে কাপড় কিনতে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ভিড় করেন পুরাতন কাপড়ের গাঁট কিনতে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা জানালেন গত কয়েক দিনে চট্টগ্রামেও ক্রেতাদের প্রচুর ভিড়। একই সাথে চাহিদার কারণে কিছুটা দামও বেড়েছে। রইসউদ্দিন নামের ব্যবসায়ী জানালেন, আমারও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এনে আবার খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে থাকি। জানা যায়, প্রতিবছরই শীতের মৌসুমে তাইওয়ান, কোরিয়া ও জাপান থেকে কয়েকশ কোটি টাকার শীতের কাপড় আমদানি করা হয়। পুরাতন কাপড় ব্যবসায়ীরা আরও জানান, গত কয়েক বছর একটু কম কম শীত থাকার কারণে একটু লস হয়েছে। এবছর সেটা পুষিয়ে লাভের মুখ দেখা যেতে পারে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত কাপড় আর আমদানির কাপড়ে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে বলেও জানালেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা তাদের ব্যবহৃত কাপড়গুলো অনেকসময় বিনামূল্যেই দান করে থাকেন অল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেও বিভিন্ন পেইজ খুলে পুরাতন কাপড় সংগ্রহ করা হয়। এসব কাপড় আবার বিতরণও করা হয়। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে দেখা গেছে, সেখানে পুরাতন কাপড় দান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আপনার পুরাতন কাপড় ফেলে না দিয়ে আমাদের জানান বলেও একাধিক আহ্বান রয়েছে বিভিন্ন পেইজে। এসব পেইজের বিষয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন শিক্ষার্থী বা তরুণ তরুণীরা নিজ উদ্যোগে এসব পুরাতন কাপড় সংগ্রহ করে থাকে এবং তা ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। অনেক সময় বেশি পরিমাণে কাপড় সংগ্রহ করে তারা শীতপ্রবণ জেলাগুলোতে পাঠিয়ে থাকে। প্রবাদে আছে ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’ পৌষের শীতে ছিন্নমূল আর নিম্ন আয়ের মানুষদের শীতের যে কষ্ট হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে সাধ্যমত চেষ্টাও করে তারা। একই সাথে দেশের বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসে শীতার্ত মানুষের পাশে।
×