ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনবিআর চেয়ারম্যান ॥ ব্যবসা বাড়লে রাজস্ব বাড়বে

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

এনবিআর চেয়ারম্যান ॥ ব্যবসা বাড়লে রাজস্ব বাড়বে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নতুন চেয়ারম্যান মোঃ মোশারফ হোসেন ভুঁইয়ার কতগুলো কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার নতুন পদে যোগদানের পর বলেছেন, রাজস্ব বোর্ড জোর-জবরদস্তি করে কর আদায় করবে না। তিনি জোর দেবেন ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধির ওপর। এসব বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব এমনিতেই বাড়বে। আর রাজস্ব দরকার জাতীয় বাজেটের খরচের জন্য। তিনি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রক্ষা করে রাজস্ব আদায় করতে চান বলে জানিয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ীকে তিনি জানেন যারা স্বনামখ্যাত। কিন্তু তারা সর্বোচ্চ করদাতা নন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার এক আত্মীয়ের কথা জানিয়েছেন যিনি শহরের সবচেয়ে বড় ধনী নন, কিন্তু সর্বোচ্চ করদাতা। আবার এও বলেছেন, শহরের সব ফ্ল্যাট মালিকরা করদাতা নন। এসব কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আমাদের মনে রাখতে হবে রাজস্ব নির্ভর করবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ওপর। সাধারণত আমরা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে শুধু টার্গেটের কথা শুনি, শুনি কর হারের কথা। শুনি ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক রাজস্ব আদায়ের তথ্য। এর ওপর ভিত্তি করে বলা হয়, রাজস্ব আদায়ে সফলতা অথবা ব্যর্থতার কথা। আমার জানা মতে অনেকদিন পর রাজস্ব বিভাগের কাছ থেকে ভিন্নধর্মী কয়েকটি কথা শুনলাম। সঠিক কথাগুলো সঠিক সময়ে বলার জন্য গোড়াতেই ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের’ নতুন চেয়ারম্যান সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক। বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজ করার অভিজ্ঞতা তার আছে। এতদিন কাজ করেছেন বাণিজ্য শিল্পের স্বার্থে। এখন তাদের স্বার্থকে আরও জোরালোভাবে দেখার সুযোগ পাবেন বলে বিশ্বাস করি। এ কথা দিনের মতো পরিষ্কারÑ রাজস্ব টার্গেট তখনই পূরণ হবে যখন ব্যবসা বাণিজ্য ভাল চলবে, যখন শিল্প কলকারখানা ভাল চলবে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল থাকলে প্রবৃদ্ধির হার উচ্চ হলে, কোম্পানিগুলোর আয় বাড়লে, কারদাতাদের আয় বাড়লে রাজস্ব আদায়ের সুযোগও বাড়বে। আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে একই মত পোষণ করে অনেকবার বলেছি, ব্যবসা বাণিজ্য ভাল থাকলে ব্যাংকের শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের (ক্লাসিফাইড) পরিমাণও কমবে, কম থাকবে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের হতভাগা দেশে টার্গেটের ওপরই বেশি জোর দেয়া হয় মূল বিষয়ের ওপর কম। ব্যাংকে ব্যাংকে একই অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। লিজিং কোম্পানি, বীমা কোম্পানি ইত্যাদিতেও অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব টার্গেটের বাড়াবাড়ি। কেউ মূল বিষয়ের দিকে যেতেই চান না। আমাদের অর্থনীতি দিন দিন উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এর আকার বড় হচ্ছে, আমরা মধ্য আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছি। স্বাভাবিকভাবেই রাজস্বও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। এখানে জোর জবরদস্তির কোন সুযোগ নেই। মনে রাখা দরকার এটা রাজস্ব আদায়ের বিষয়। যিনি কারদাতা তারও অনেক বিবেচ্য বিষয় আছে। করদাতা যেমন কর দেবেন, তেমনই কর আদায়কারীও তার জন্য বিনিময়ে কিছু করবেন। রাজস্ব কর্মকর্তারা এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা তাদের আয় বাড়াতে পারেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি বর্তমান অবস্থা সুখকর নয়, একটা ভীতিজনক অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত কর ব্যবস্থার ভীতিজনক অবস্থা দূর করার জন্য একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করেছে। ওই দেশের সরকারী দলের নেতারা আয়কর তুলে দিতে চান। নির্বাচনের আগে তারা এ বিষয়ে অঙ্গীকারও করেছেন। কমিশন এ বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। আমরা জানি না শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে। তবে এ কথা আমাদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আয়কর এবং কর ব্যবস্থা আমাদেরও সেকেলে। প্রাচীন ধ্যানধারণা, নিয়মনীতি একটু অদলবদল করে চালু রাখায় বড় সমস্যা হচ্ছে। এসব দূর করা দরকার। যেমন আমরা শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, ‘যার আয় বেশি তিনি কর দেবেন বেশি।’ এতে সমাজের সাম্য বজায় থাকে। এর জন্য তাই সবসময়ই বলা হতো প্রত্যক্ষ করের কথা। প্রত্যক্ষ কর বেশি হবে। পরোক্ষ করের গুরুত্ব কমানো হবে। কিন্তু ইদানীং সব দেশের মতো আমাদের দেশেও পরোক্ষ করের গুরুত্ব বাড়ছে, প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব কমছে। ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর এটি ভোগ করা অর্থাৎ ব্যয়কর। ভ্যাট এখন একটা সর্বগ্রাসী কর ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। সব দেশেই তাই। অথচ এই কর ব্যবস্থায় সুবিচারের কোন পথ নেই। এই ক্ষেত্রে ধনী যেভাবে কর দেবেন গরিবরাও একই হারে কর দেবেন। এতে সমতা, সাম্য, সুবিচারের ব্যবস্থা কোথায়? অথচ সারা পৃথিবী এদিকেই ধাবিত হচ্ছে। যেমন উৎসে কর কাটার ব্যবস্থা। উৎসে কর কাটার ব্যবস্থা রাজস্ব বিভাগের জন্য খুবই সুব্যবস্থা। এতে তাদের লোকবল কম লাগে। ঝামেলা কম, কর আদায়ের নিশ্চয়তা শতভাগ। এর ফলে রাজস্ব বিভাগের জটিলতাও কমে। কিন্তু উৎসে কর কাটার ফলেও ‘ইক্যুইটি’র প্রশ্নটি উপেক্ষিত হয়। এখানেও ধনী, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সমভাবে করভারে জর্জরিত হয়। বর্তমান ব্যবস্থায় অবশ্য আরেকটি সমস্যাও হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আমার ধারণা হাজার হাজার ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তনের কারণে করদাতাকে বেশি কর দিতে হয়। বলা হয় বেশি কর কাটা হলে তা সমন্বয়যোগ্য। কিন্তু তা যে হয় না তা বলাইবাহুল্য। এতে বহু করদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ আলোচনায় একটা মূল কথা যা এখানে বলা দরকার। মূল কথাটা হলো আয়কর ও ভোগকর বা ব্যয়। করদাতা আয়কর বা ইনকামটেক্স দিলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর দেবে কেন? এটা ডাবল টাক সেশন হয় না কী? না কি এটা আমার বোঝার ভুল? তত্ত্বগত সমস্যা বাদ দিয়ে কতগুলো বাস্তব সমস্যার কথা বলি যা নতুন চেয়ারম্যান সাহেব বিবেচনা করে দেখতে পারেন। ব্যাংকে প্রাপ্ত সুদের ওপর ১০-১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান আছে। আমার ধারণা এটিকে সহজেই ৫-১০ শতাংশে হ্রাস করা যায়। এতে করদাতার সুবিধা একটা হবে। আয়কর সমন্বয়ের অসুবিধা থেকে অনেকেই রেহাই পাবেন। দ্বিতীয়ত আরেকটি অসুবিধার কথা বলা দরকার। আর সেটা হচ্ছে ‘সম্পদকর’। অনেক প্রত্যাশা করে সম্পদকর চালু করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি ফলপ্রসূ হয়নি। খুবই অল্পসংখ্যক লোক এই ব্যবস্থায় সম্পদকর দেয়। সংখ্যাটা নিতান্তই হাস্যকর। সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদ থাকলে বর্তমানে দশ শতাংশ হারে সম্পদকর দিতে হয়। খবরের কাগজে দেখেছি এখানে মাত্র ৫-৭ হাজার লোক সম্পদকর দেয়। ১০-১৫ লাখ করদাতার মধ্যে মাত্র ৫-৭ হাজার সম্পদকরের আওতায় পড়ে এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা, যেখানে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাটের মূল্যই আশি লাখ-এক-দেড় কোটি টাকা। জমির মূল্যের হিসাবে গেলেও এই তথ্য বিভ্রান্তিকর তথ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, পূর্বাঞ্চলের বাড়ি ফ্ল্যাট ও জমির মালিকই তো হবে কয়েক লাখ। তাদের সম্পদের মূল্য কত? এরা সবাই কী সম্পদকরের আওতায় পড়েছে? অবশ্যই নয়। এমতাবস্থায় এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। তৃতীয়ত, বর্তমানে ঝোঁক বেশি বিদ্যমান করদাতাদের ওপর। এরা তো করজালের মধ্যেই আছে। কম বেশি কর তারা দিচ্ছে। আমাদের দরকার নতুন নতুন করদাতা। অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত যোগ হচ্ছে। এর আকার বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব খাতে করদাতা তৈরি হচ্ছে। যেমন নতুন চেয়ারম্যান সাহেব ফ্ল্যাট মালিকদের কথা বলেছেন। এদের করের আওতায় আনুন। উপজেলা পর্যায়েও আজকের দিনেও কোটি কোটি টাকার মালিক আছে। তাদের ধীরে ধীরে করের আওতায় আনুন। যা দরকার তা হচ্ছে জালের বিস্তার ঘটানো। যারা কর দিচ্ছে তাদের অভয় দেয়া। তাদের অহেতুক প্রকল্পের মধ্যে না ফেলা। আরেকটি জরুরী কাজ আছে। খবরের কাগজে দেখেছি ভ্যাট ফাঁকির কথা। প্রতিদিনই এসব খবর ছাপা হচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি, নামকরা কোম্পানি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ ভ্যাট দিচ্ছে। তাদের দেয়া কর কোম্পানিগুলো এবং বিক্রেতারা সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে না। কিছুদিন আগে এনবিআরের উর্ধতন এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বছরে শুধু ভ্যাট খাতেই ফাঁকি দেয়া হয় ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এর দ্বারা কী বোঝা যায়? অন্ধের মতো রাজস্বের জন্য এখানে-সেখানে না গিয়ে এই খাতেই নিয়োগ করা দরকার সকল শ্রম ও মেধা। আমার ধারণা, নতুন চেয়ারম্যান সাহেবের ধারণা এখানে কাজে লাগাতে পারে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে ভ্যাট খাত থেকে আরও অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। অবশ্য ভ্যাট খাতটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করেই বলা যায়, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করাকে স্থগিত করিয়েছে। আমার ধারণা নতুন চেয়ারম্যান সাহেব তার মেধা দিয়ে এই আইনকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবেন। ভ্যাট বাদে অনেক ছোটখাটো বিষয় আছে যেসবের ওপরও নজর দেয়া দরকার। আমার ধারণা ‘এনবিআর’-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টার্গেটের ভারে জর্জরিত। টার্গেট বেশি হলে কেউ কাজ করে না। আর টার্গেটের যন্ত্রণায় কর্মকর্তারা তখন বিদ্যমান করদাতাদেরই পেয়ে বসে। বিদ্যমান করের ওপরই ‘কারিগরি’ শুরু করে। যেমন বর্তমান ব্যবস্থায় মোট আয়ের একটা অংশ বিনিয়োগ করা যায়। এটা দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। বিনিয়োগ করলে কিছুটা কর রেয়াত পাওয়া যায়। এই রেয়াত হিসাবের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিবর্তন এনে একে এমন জটিল করা হয়েছে যে, একজন সাধারণ করদাতার পক্ষে রেয়াত হিসাব করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ এতে ‘এনবিআর’-এর লাভ খুব বেশি নেই। ‘অডিটের’ ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গত সপ্তাহেই কাগজে পড়লাম ‘অডিট’ ব্যবস্থা এখন কর কর্মকর্তাদের কাছেই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করদাতার বোঝা তো স্বাভাবিক। এসব অনেক ছোটখাটো সমস্যা আছে। তবে এরই মধ্যে বড় একটা সমস্যার কথা বলি। প্রতিবছর করের হারসহ নানা ধরনের পরিবর্তনের কারণে করদাতারা হয়রানির সম্মুখীন হন। আর পরিবর্তন যখন হয় তখন এর সুবিধা অথবা অসুবিধা ভোগ অথবা তা সামলানোর সময় থাকে না। এটা কোনভাবেই ন্যায্য নয়। অতএব কথা হয়েছিল করের হারসহ নানাবিধ সুবিধা কয়েক বছরের জন্য বহাল রাখা হবে যাতে করদাতারা বুঝতে পারে তাদের কোন নিয়মের অধীনে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এই কাজটি দ্রুত সেরে ফেলা দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×