ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কেউ অপরাধ করলে শাস্তি তাকে পেতেই হচ্ছে ॥ পুলিশ সদর দফতর

এক শ্রেণীর বিপথগামী পুলিশের কারণে সঙ্কটে বাহিনীর ইমেজ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১১ জানুয়ারি ২০১৮

এক শ্রেণীর বিপথগামী পুলিশের কারণে সঙ্কটে বাহিনীর ইমেজ

শংকর কুমার দে ॥ ‘রক্ষকই- ভক্ষক’ নামের অভিযুক্ত এক শ্রেণীর অসৎ, দুর্নীতিবাজ, বিপথগামী পুলিশের কারণে ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে গোটা পুলিশ বাহিনীর। পুলিশ সপ্তাহ চলাকালে পুলিশ বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তা ডিআইজি মিজানুর রহমান নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে প্রত্যাহার হওয়ার ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ২০১২ থেকে বিদায়ী ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিগত ছয় বছরে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের লক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর গুরুদ- ও লঘুদ-- দুই ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার পুলিশকে। বিগত ছয় বছরের পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর নানা অপরাধে জড়িয়ে অন্তত ১৩ হাজার সদস্যকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ১১ শ’ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। দৈনিক অন্তত ৩৮ পুলিশ সদস্য আইন অমান্য করা থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে শাস্তি পাচ্ছেন। নানা ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১২ থেকে বিদায়ী ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫১১ পুলিশ সদস্য চাকরিচ্যুত এবং ৪২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বাহিনীতে কেউ অপরাধ করলে কেউই রেহাই পাচ্ছেন না, শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এরপরও তাদের অপরাধ প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ডিআইজি মিজানের মতো এত উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে দ্রুততার সঙ্গে প্রত্যাহার করা, পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্তি, তদন্ত ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্বলে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর আগে গত বছর ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ সাহা ও তার স্ত্রীর নামে ৮ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তের ঘোষণা দেয়। একই বছরে কক্সবাজারের টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপরহণের পর মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ সেনাবাহিনীর হাতে আটক জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৭ সদস্যকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় দেশব্যাপী পুলিশের অপরাধ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেণীর অসৎ ও দুর্নীতিবাজ সদস্যের বিরুদ্ধে খুন থেকে শুরু করে গ্রেফতার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এত ব্যাপকসংখ্যক অপরাধের তদন্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদেরই দাবি। বাংলাদেশ পুলিশ এ্যাক্ট-১৮৬১ অনুযায়ী, কোন পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘু, অন্যটি গুরুদ-। গুরুদ-ের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ করা। বিভাগীয় মামলা রুজু। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে গুরুদ-ের বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছোট ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদ- দেয়া হয়। তবে ফৌজদারি অপরাধের বেলায় গ্রেফতার, সরাসরি আদালতে সোপর্দ, মামলা রুজু, কারাগারে প্রেরণ ইত্যাদি শাস্তির ব্যবস্থা আছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের মধ্যে পুলিশের সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। ইতোমধ্যেই আলোচ্য সময়ে অর্ধ লক্ষাধিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুদ- ও লঘুদ- দুই ধরনের দ- দেয়া হয়েছে। ‘এ যেন শর্ষেই ভূত!’ যে পুলিশ দিয়ে অপরাধ দমন করা হবে, সেই পুলিশেরই একাংশ বিপথগামিতায় জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিনারি বিভাগে জমা পড়া অভিযোগগুলো এখন তদন্তাধীন। পুলিশের ক্রমবর্ধমান বেপরোয়া আচরণের শাস্তি দেয়ার পরও অপরাধ না থামার বিষয়টি উদ্বেগজনক। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য পৃথক কোন তদন্ত সংস্থা নেই। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ থেকে তদ্বির তোয়াজ করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পার পেয়ে যায়। আবার পুলিশের ডিআইজি মিজানের মতো উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাকেও রেহাই দিচ্ছে না সরকার। অপরাধ দমন যাদের কর্তব্য সেই পুলিশ সদস্যরা নিজেরাই যেভাবে একের পর এক অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছেন তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, শ্লীলতাহানি সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশ সদস্যরা। কনস্টেবল থেকে পদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধের সঙ্গে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কর্মকা- পেশাদার অপরাধীদেরও হার মানাচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও কমছে না অপরাধ প্রবণতা। কতিপয় সদস্যের অপকর্মের দায়-দায়িত্ব নিতে হচ্ছে গোটা পুলিশ বাহিনীকে। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছয় বছরে নানা অপরাধে ৮১ হাজার ৪২৬ পুলিশকে অর্থদ-, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক পদমর্যাদার। আর পরিদর্শক থেকে তদুর্ধ পর্যায়ের কর্মকর্তা ৩২৭। অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারিসহ বিভাগীয় মামলায় বিচারে সাজা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধে জড়ানোর হার কমছে না। মাঠ পর্যায়ে কতিপয় পুলিশ সদস্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো অপরাধ করছে। তাছাড়া অপরাধী গ্রেফতারে সোর্স হিসেবে যাদের রাখা হয় তাদের ব্যবহার করে পুলিশ সদস্যরা অপরাধ ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদনই থেকে যায় আড়ালে। শাস্তিও হয় না তেমন একটা। প্রত্যাহার, সাময়িক বরখাস্ত, বদলি এর মধ্যেই আটকে থাকে। এক শ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধের কারণে সরকারী এ সংস্থাটি এখন নানা প্রশ্নের মুখে। পুলিশের অপরাধ প্রমাণের পরে মাঝেমধ্যে শাস্তি হলেও থেমে নেই পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকা-। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, আটক করে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ অভিযোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। কিছু কিছু অভিযোগ পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নজরে এলে অনেক ঘটনাই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। রাজনৈতিক তদবিরে নিয়োগ, বদলি পদোন্নতির কারণে অনেক পুলিশ সদস্যই তাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পর্যন্ত পাত্তা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ এখন বেপরোয়া। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা স্বীকার করি অল্প কিছু পুলিশ সদস্যের অপেশাদার আচরণ ও নৈতিক স্খলন পুরো বাহিনীর অনেক বড় বড় অর্জনকে কখনও কখনও ম্লান করে দেয়ার উপক্রম করে। আমরা আবারও বলছি শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। ব্যক্তি পুলিশের দায় বাংলাদেশ পুলিশ কখনও নেয় না। পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অনুসন্ধান করে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের অপরাধ বা অভিযোগের দায় গোটা পুলিশ বাহিনী বহন করবে না। পুলিশ বাহিনীর কোন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষ তা কোন অবস্থায়ই হালকা করে দেখে না। শৃঙ্খলার বিষয়ে পুলিশে একটুও ছাড় দেয়া হয় না। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশের ভূমিকা দেশ-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করছে। দু’একজন বিপথগামী পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই পুলিশের চরম আত্মত্যাগ ও সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপনসহ দেশ-বিদেশে সুনামও কুড়ানোর অসংখ্য উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত আছে।
×