ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিনি এলেন এবং জয় করলেন

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

তিনি এলেন এবং জয় করলেন

১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানীদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে আসেন। দিনটি বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক স্মরণীয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু হানাদারমুক্ত পবিত্র বাংলার মাটিতে ফিরে আসলে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার হৃদয়ে নজিরবিহীন আনন্দের প্লাবন সৃষ্টি হয়েছিল। মাত্র ২৪ দিন আগে খুনী জল্লাদ হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শোচনীয় পরাজয়বরণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ত্রিশ লাখ শহীদের পবিত্র রক্তে বিধৌত মুক্ত বাংলার মাটি তখন স্বাধীনতার তরুণ ধারায় রক্তিম কিরণে উদ্ভাসিত। আমাদের ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দীদশা হতে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন হানাদারমুক্ত বাংলার মাটিতে। মহান নেতাকে বিরোচিত সংবর্ধনা জানাতে এবং এক নজর দেখার জন্য নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ-যুবক নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমায় ঢাকা শহরে। তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকে লাখ লাখ মানুষ। রাস্তার দু’ধারের বাসাবাড়ি ও দালান-কোঠার ছাদে-বারান্দায় এবং গাছের ডালে পর্যন্ত উঠে থাকে বহু মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে দেখার জন্য। সংবর্ধনা সভায় নির্দিষ্ট স্থান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যান) সেদিন পরিণত হয়েছিল বাঙালীর তীর্থভূমিতে। বিশাল ময়দানের কোন স্থানে তিল ধারণের স্থান ছিল না। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনা সভার মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ নয় মাস পর প্রিয় নেতাকে দেখামাত্র লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় গগন বিদারী স্লেøাগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা দীর্ঘজীবী হোক, মুজিব ভাই দীর্ঘজীবী হোক। সেদিন আরও স্লেøাগান ওঠে বাঙালীর কণ্ঠে বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ, মুজিববাদ। লাখ লাখ বাঙালীর কণ্ঠের স্লোগানের গর্জনে সেদিন ঢাকার আকাশ-বাতাস ছিল মুখরিত। মুহুর্মুহু স্লোগান আর করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪০ মিনিট ভাষণ দেন। তিনি ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ জানান সোভিয়েত রাশিয়াকে। তিনি আমেরিকাসহ যে সমস্ত দেশের জনসাধারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের এক কোটি গৃহহীন মানুষকে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে প্রতিপালন করার জন্য ভারতের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি নেতাকর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেন, আমরা যদি আমাদের জনসাধারণের অন্ন, বস্ত্র ও কাজের সংস্থান করতে না পারি তাহলে আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। দীর্ঘ নয় মাস পর রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে ভাষণ দেন। আজীবন সংগ্রাম-সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরে স্বভাবতই তাঁর কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, প্রশাসকবিহীন একটি দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর তা পরিচালনার সুকঠিন চ্যালেঞ্জ তিনি সাহসিকতার সঙ্গে গ্রহণ এবং মোকাবেলা করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশকে মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের উপযোগী সংবিধান উপহার দেন। ইংরেজ বিদায়ের পর যা ভারত, পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব হয়নি তা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব করেছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয়। ভারত তার সংবিধান রচনা করে স্বাধীনতার ৩ বছর পর ১৯৫০ সালে। আর বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাত্র ১ বছর পর ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধানের চারটি মূল নীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা জাতীয়তাবাদ। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সদস্যপদসহ পাকিস্তান ও অন্য আরও ১৩৯টি দেশের স্বীকৃত লাভ বঙ্গবন্ধু সরকারের কৃতিত্ব। বঙ্গবন্ধুর বড় আরেক কৃতিত্ব অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান গ্রহণকারী বন্ধুপ্রতিম ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী সৈন্য ও সাধারণ নারিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন। বন্ধুপ্রতিম ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন করেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান ও নির্যাতিত মা-বোনদের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন ও আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার প্রদান করে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার চাকরির ব্যবস্থা করেন। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৩৫ লাখ টন। বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায় ২৭ লাখ টন খাদ্য বিদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করে। দেশের শতকরা ৪৪ জনকে রেশনের মাধ্যমে খাদ্য প্রদানের ব্যবস্থা চালু করে। ১৯৭৪ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। তার মোকাবেলার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লঙ্গরখানা স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে তাঁর রক্তের উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অর্থনৈতিক, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, চিকিৎসাসহ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হন। তিনি ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হয়েছেন। তিনি উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমন, অসাম্প্রদায়িক দেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে, সংঘাতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবিক আহ্বান নিয়ে। শান্তির জননী হিসেবে আজকে তিনি দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে অবস্থান নিয়েছেন সেটি আমাদের দেশ ও জাতির জন্য যেমন শিক্ষণীয় ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি শ্রেষ্ঠ মানবিক উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে, গড় আয়ু বাড়িয়ে, শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে এবং ক্রমবর্ধমান জিডিপিকে অব্যাহত রেখে। আজকের বাংলাদেশের উদাহরণ সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বাংলাদেশকে যেমন সঠিকপথে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তেমনি বিশ্বমানবতা এবং শান্তির পক্ষে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবেন। বিশ্বে একজন, অনন্য মানবিক গুণসম্পন্ন শান্তির পক্ষের নেতা হিসেবে তিনি যে উদাহরণ রেখেছেন তা অব্যাহত রাখবেন বলে আমি আশা করি। তার হাতে সব সময় শান্তির পতাকা থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ তার হাতে শান্তির পতাকা দেখে উৎসাহিত হবে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়েছেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সে লক্ষ্য পূরণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালী জাতি সফল হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখি। তিনি বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তির প্রতীক হয়ে থাকবেন। আমি দেশবাসীকে অনুরোধ করব সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। এ লক্ষ্যেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে এক মঞ্চে আসতে হবেÑ এটাই ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি স্মরণে আমার একান্ত কাম্য। লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×