ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

জ্ঞানের আলোয় অবাক সূর্যোদয়!

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

জ্ঞানের আলোয় অবাক সূর্যোদয়!

কোন এক জাতিকে যদি মানসিকভাবে শিক্ষিত করতে চাও তাহলে তাদের বই উপহার দাও। প্রবাদটি নিহায়ত ভুল নয়। মানব জীবনে বই এক পরম বন্ধু, পরম আশ্রয়। জীবনের বন্ধ দরজা-জানালাগুলো খুলে দেওয়ার জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। বইয়ের পাতায় সঞ্চিত থাকে হাজার বছরের সমুদ্র-কল্লোল। অতীত ও বর্তমানের অনন্য সেতুবন্ধন হলো বই। মানুষের মনোরাজ্যের দিগন্তকে প্রসারিত করে আলোকিত মানুষ হতে বইয়ের বিকল্প নেই। কারণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে গেলে জ্ঞান অর্জন ছাড়া উপায় নেই। টলস্টয় যথার্থই বলেছেন, মানব জীবনের তিনটি অনুষঙ্গ হচ্ছে-বই, বই, বই। ‘জ্ঞানের আলোয় অবাক সূর্যোদয়!/ এসো পাঠ করি/ বিকৃতির তমসা থেকে/ আবিষ্কার করি স্বাধীনতার ইতিহাস’ এই স্লোগান কে ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছে ‘ইনোভেটর’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা সিলেটের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হচ্ছে ইনোভেটর। যাদের পথচলা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানা ও জানানোর মহানব্রত নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির প্রত্যেক সদস্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই, আয়োজন করেন উৎসব, প্রতিযোগিতা এবং প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন পুরস্কার। উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্ম বই পড়ার আগ্রহ লাভ করুক, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানুক। শুরুর কথা জানতে চাইলে ইনোভেটরের নির্বাহী সঞ্চালক প্রণবকান্তি দেব বলেন, সময়টা ২০০৬ সাল। যেন এক অন্ধকার সময় তখন। চিহ্নিত মানবতাবিরোধী অপরাধীরা সক্রিয়। কেউ কেউ মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশ। পাঠ্যপুস্তক থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। ‘সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে আমরা যারা কাজ করতাম অনেকের মতো আমরাও বিচলিত ছিলাম। রাষ্ট্রের ক্রমাগত এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবছিলাম।’ সেই থেকেই পথ চলা তাঁরা বই তুলে দিলেন শিক্ষার্থীদের হাতে। আয়োজন করলেন উৎসবের। ইনোভেটরের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাঁরা পরিকল্পনা করে বই তুলে দিলেন শিক্ষার্থীদের হাতে। আযোজন করলেন বই পড়া উৎসবের কিন্তু নিবন্ধন করলেন মাত্র ৬০ জন শিক্ষার্থী। সংখ্যাটা নিতান্ত কম হলেও নিরাস হলেন না তাঁরা। আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন আয়োজকরা। আর তাদের আত্মবিশ্বাসী মনের প্রত্যাশাকে সাড়া দিয়ে বছর বছর বাড়তে থাকল শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এখন সেটা হাজারের কোঠা পেরিয়েছে। বই পড়া উৎসবে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে ২০১৬ সাল থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ‘টানা এক দশক ধরে কোন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই প্রতিবছর বইপড়া উৎসব পালিত হয়ে আসছে। তাঁদের প্রথম আসর শুরু হয়েছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বই দিয়ে। এরপর শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, হাসান আজিজুল হকের নামহীন গোত্রহীন, মেজর (অব) কামরুল হাসান ভূঁইয়ার জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা, মাহমুদুল হকের খেলাঘর, শওকত ওসমানের দুই সৈনিক, আনোয়ার পাশার রাইফেল, রোটি, আওরাত, শাহীন আখতারের তালাশ, সেলিনা হোসেনের গল্পটা শেষ হয় না এবং সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান-এর মতো বিখ্যাত সব বই। নির্বাচিত বই বিতরণ ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক ও গুণীজনদের হাজির করার চেষ্টা চলে। এ তালিকায় আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, লেখক সেলিনা হোসেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, লেখক আবদুশ শাকুর, মেজর (অব) কামরুল হাসান ভূঁইয়া, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোঃ আনোয়ার হোসেন, চিত্রনায়ক ফারুক, এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীমসহ অনেকে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বই পাঠ করানোর স্বীকৃতিও পেয়েছে সংগঠনটি। ২০১৭ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়েছে ইনোভেটরকে। সেই শুরু থেকেই বইপড়ার কাজটিকেই এগিয়ে রেখেছে ইনোভেটর। ইনোভেটর পুরো আয়োজনটা প্রায় ছয় মাসের। অক্টোবর মাসে শুরু হয় নিবন্ধনের প্রক্রিয়া। বইপাঠে আগ্রহীরা নবেম্বর মাস পর্যন্ত নিবন্ধন করার সুযোগ পায়। ডিসেম্বর মাসে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসবের মাধ্যমে নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় বই। এ বইপড়া শেষে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হয় বইপড়া উৎসবের। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেয়া হয়। মার্চে আরেকটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে ফি নেয়া হয়। এই টাকায় তারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্বাচিত বইসহ অন্যান্য সুবিধা পায়। ‘ইনোভেটর বইপড়া উৎসবটি কে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে চায়, চায় মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপনের মাধ্যমে ইতিহাস সংরক্ষণ, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত বই পড়ায় উৎসাহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠের বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিকরণ। তাছাড়া আমাদের এই যান্ত্রিক সময়ের মাঝেও উচিত আমাদের বইয়ের জন্য সময় বের করা। কারণ বই শাশ্বত, বই চির তরুণ। যুগে যুগে, কালে কালে সভ্যতার ক্রমবিকাশে বই আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। সত্য, সুন্দর আর কল্যাণের পথে এগিয়ে যেতে হলে বই পড়া অবশ্যম্ভাবী। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজনীতিসহ জ্ঞানের এক অফুরান ভাণ্ডার হলো বই। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে এসে নতুন প্রজন্ম বই পড়া ভুলে যাচ্ছে। অথচ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জগতকে প্রসারিত করতে হলে বই পাঠে মনোযোগী হতে হবে। একটি ভাল বই অশান্ত মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। বই পড়ার এই রঙিন অধ্যায়কে বিবর্ণ হতে দেওয়া যাবে না কোনভাবেই।
×