ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কল্পনার চেয়েও বেশি সাফল্য দেবে পরিশ্রম

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

কল্পনার চেয়েও বেশি সাফল্য দেবে পরিশ্রম

কর্পোরেট দুনিয়ায় ম্যারি নামে পরিচিত। পুরো নাম ম্যারি তেরেসা বারা। জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বিশ্বের অটোমোবাইল ব্যবসায় সর্ববৃহৎ দায়িত্বে প্রথম কোন নারী হিসেবে ম্যারি বারা সব সময়ই আলোচিত। সর্বশেষ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ৭৪ ব্যক্তির একটি তালিকা দিয়েছে বিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী। এ তালিকায় মাত্র ছয়জন নারী আছেন। ফোর্বসের এ তালিকায় জেনারেল মোটরসের (জিএম) সিইও ম্যারি বারা আছেন ৬২তম অবস্থানে। ম্যারি বারা ১৮ বছর বয়সে শিক্ষানবিস হিসেবে জেনারেল মোটরসে কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। ২০১৪ সালে জেনারেল মোটরের (জিএম) প্রধান নির্বাহী ম্যারি বারাকে ১৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে। এটি সাবেক প্রধান নির্বাহী ড্যান এ্যাকারসেনের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। এ্যাকারসনের পারিশ্রমিক ছিল ৯ মিলিয়ন ডলার। বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম নারী তিনি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে এ পদে পদোন্নতি পান তিনি। ২০১৪ সালে জিএম নির্মিত একটি মডেলের গাড়িতে ইগনিশন সুইচের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনায় ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ঘটনায় জিএম ওই মডেলের ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন গাড়ি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এতে প্রায় ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। ২০১৪ সালের গাড়ি প্রত্যাহার কেলেঙ্কারির পর কোম্পানির সুনাম ফিরিয়ে আনতে নিরলস পরিশ্রম করেছেন বারা। এ পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবেই তার বেতন বৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৪ সালে পাওয়া বারার বেতন ছিল ২০১৩ সালের আয়ের তুলনায় তিন গুণের বেশি। ওই বছর তিনি ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক পেয়েছেন। শ্রমিক ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেতনভোগী কর্মীর তুলনায় বারার বেতন ২৯০ গুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন ম্যারি বারা। ২০১৬ সালের ১১ জুন নিজ ক্যাম্পাসেই তিনি গিয়েছিলেন সমাবর্তন বক্তা হয়ে তার সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরা হলো ... অভিনন্দন স্নাতক বন্ধুরা! মনে হচ্ছে প্রায় এক জীবন আগে আমি তোমাদের আসনে বসে ছিলাম। সমাবর্তনের রোমাঞ্চ আমার মনে আছে। তোমাদের দেখে আজ আবার সেই রোমাঞ্চ অনুভব করছি। তোমরা স্ট্যানফোর্ডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাচ। তোমাদের ক্লাসে শতকরা ৪২ ভাগ নারী। শতকরা ৪৪ ভাগ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। এমনকি তোমাদের ক্লাসে বিশ্বের ৬২টি দেশের প্রতিনিধি আছে। আমি যখন স্নাতক করেছি, পৃথিবীটা সে সময়ের তুলনায় এখন অনেক বদলে গেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’ বলে একটা চমকপ্রদ জিনিসের সঙ্গে তখন মাত্রই পরিচয় হয়েছে। স্মার্টফোন, এসএমএস বলে কিছু ছিল না। মুঠোফোন যখন এলো, সেটা শুধু কথা বলার কাজেই ব্যবহার হতো। তবে সবকিছু বদলে যায়নি। স্ট্যানফোর্ড এখনও বিশ্বের অন্যতম সেরা স্কুল। এ কথা আমি জানি, কারণ তোমাদের যে শিক্ষকরা পড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আমারও শিক্ষক ছিলেন। আমি জানি, যে নতুন পথ তোমাদের সামনে অপেক্ষা করছে, তোমরা তার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এই পথ একদিন আমিও পেরিয়ে এসেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তোমাদের যাত্রা কেবল শুরু। স্ট্যানফোর্ডে এসেই প্রথম জেনেছিলাম, আমি কী জানি না, আমি আসলে সেটাই জানি না। বয়স ছিল ২৬। সাউথ ইস্ট মিশিগানে বড় হয়েছি। ১৮ বছর বয়স থেকে জেনারেল মোটরসে কাজ করেছি। স্ট্যানফোর্ডে এসে আমি নতুন করে সবকিছু দেখতে শিখলাম। ক্যাম্পাস আমার পুরো জীবন বদলে দিল। ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের কৌশল শিখলাম। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেতৃত্ব বিষয়ক ৪টি শিক্ষা আজ তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। এই শিক্ষাগুলো আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আশা করি তোমাদের কাজে লাগবে। প্রথমত, নেতৃত্ব দিতে হলে অন্যের কথা শুনতে হয়। তুমি যদি কিছু না জানো, সেটা মেনে নিতে তো সমস্যা নেই। সাহায্য চাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। তুমি যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছ, তাদের কথা তোমাকে শুনতে হবে। তোমার চারপাশে এমন মানুষ থাকা উচিত, যারা তোমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তুমি যখন ভুল করবে, তারা তোমার ভুল ধরিয়ে দেবে। তুমি যখন একটা বড় পদে চলে যাবে, জেনারেল ম্যানেজার কিংবা প্রধান নির্বাহী হবে, তখনও কিন্তু অন্যের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না; বরং বাড়বে। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব দিতে হলে তোমাকে অন্যের দেখভাল করতে হবে। আশির দশকের শেষ দিকে আমি এখানে পড়ালেখা করেছি। তখন এমবিএ ডিগ্রীধারীদের ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়াল স্ট্রিট ছবির গর্ডন গেকো চরিত্রটির সঙ্গে তুলনা করা হতো। মাইকেল ডগলাস এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। গর্ডন গেকোর মন্ত্র ছিল সহজ : লোভ থাকা ভাল। আজকের পৃথিবীতে অনেকেই ব্যবসায়ীদের অবজ্ঞা করে। গ্যালাপের একটি সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করে না। তুমি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকার, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কিংবা দাতব্য সংস্থা, যেখানেই নেতৃত্ব দাও না কেন, সমাজে তোমার প্রতিষ্ঠানের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার দায়িত্ব তোমার। সমাজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জেনারেল মোটরসে আমার দায়িত্ব যেমন গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। ব্যবসায় তুমি যত ভালই কর না কেন, যতক্ষণ না তোমার কাস্টমার তোমাকে জয়ী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, ততক্ষণ তুমি জয়ী নও। তৃতীয় শিক্ষাটি হলো একজন নেতা সব সময় অনুপ্রাণিত করে। প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে কাস্টমারের সন্তুষ্টির ওপর। এটা যেমন সত্যি, তেমনি কর্মীদের সন্তুষ্টিও খুব জরুরী। আমার বিশ্বাস, একটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয় করতে পারে। এটাই একজন নেতার দায়িত্ব। এমন একটা কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন কর্মীরা তাঁদের সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য অবদান রাখতে পারেন। দিন শেষে মানুষগুলোই প্রতিষ্ঠান। ভেতরের এবং বাইরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্কই একটা ব্যবসায় সাফল্য এনে দিতে পারে। এটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কর্মীদের কাছে দায়বদ্ধ থাকি। আমরা কী করছি আর কী করতে যাচ্ছি, সে সম্পর্কে তাঁদের পরিষ্কারভাবে বলি। তাঁদের অনুপ্রাণিত করি যেন তাঁরা নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন। চতুর্থ শিক্ষা, নেতা হতে হলে কাজ করতে হয়। শুধু মেধা থাকলে হয় না। কারণ পরিশ্রম দিয়ে একজন মেধাবীকে হারানো যায়, কিন্তু মেধা দিয়ে একজন পরিশ্রমিকে হারানো যায় না। আমি মাঝেমধ্যে আমার মা-বাবার কথা ভাবি। খুব হতাশার মধ্য দিয়ে তাঁরা বড় হয়েছেন। মা নর্দার্ন মিশিগানে একটা ফার্মে থাকতেন। বাবা বেড়ে উঠেছেন মিনেসোটার একটা ধাতব খনির এলাকায়। তাঁরা তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা পাননি। দুজনেরই স্রেফ হাই স্কুলের ডিগ্রী ছিল। কিন্তু তাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন, আর স্বপ্নপূরণের জন্য পরিশ্রম করেছেন। আমাকে আর আমার ভাইকে শিখিয়েছেন, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আগে কাজ, তারপর খেলা। তাঁরা শুধু একটা পরিবার গড়েননি, একটা বিশ্বাসের ভিত গড়েছেন। সেই বিশ্বাসের ওপর আমরা বেড়ে উঠেছি। শিক্ষা তোমার সামনে দরজা খুলে দেবে। মেধা তোমার সামনে দরজা খুলে দেবে। কিন্তু তোমাকে কল্পনার চেয়েও বেশি সাফল্য এনে দেবে তোমার পরিশ্রম।
×