ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সরিষা ফুলের মধু এখন রফতানিও হয়- রাজস্ব আয়ের উৎস...

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

সরিষা ফুলের মধু এখন রফতানিও হয়- রাজস্ব আয়ের উৎস...

সমুদ্র হক ॥ মধুর ফুল অনেক। সবচেয়ে ভাল মধুর ফুল এখন শর্ষে বা সরিষা। একে মৌ ফুলও বলা যায়। মৌমাছি এই ফুল থেকেই মধু সংগ্রহ করে বানায় মৌচাক। কতই না কথা সরিষাকে নিয়ে। বাঙালি জীবনে অতি ছোট্ট এক দানা এশিয়ার অন্যতম রবি শস্য সরিষা। উপমহাদেশে সরিষার আগমন ঘটায় পর্তুগীজরা। তারা কৃষি ফসলের নানা কিছু খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা আবিষ্কার করে দ্বিবীজপত্রী একবর্ষজীবী প্রজাতির উদ্ভিদ। এরই একটি সরিষা। শীতের আগমনীতে এর আবাদ। শেষ হয় শীত পাড়ি দিয়ে। রবিশস্যের আসনে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামীণ জীবনে শীতের মৌসুমে বিস্তীর্ণ মাঠ নিসর্গে পরিণত হয় সরিষার ফুলে। সরিষাকে নিয়ে কত যে কল্প-গল্প! ভূত তাড়াতে সরিষা লাগে (এটা অবশ্য কুসংস্কার)। সরিষার মধ্যেই যদি থাকে ভূত, তাহলে ভূত পালাবে কি করে (এটি রূপক অর্থে)। চোখে সরষের ফুল দেখছে (রূপক অর্থে)। কলুর বলদ কথাটি এসেছে সরিষা থেকেই। এক সময় যাদের তেলের ঘানি ছিল তাদের বলা হতো কলু। ঘানিতে বলদকে কাঠের সঙ্গে বেঁধে চারদিকে ঘুরিয়ে সরিষা ভেঙ্গে তেল বের করা হয়। দিনমান এই বলদ ঘোরে। রূপক অর্থে যিনি সংসারের ঘানি টানেন তাকে বলা হয় কলুর বলদ। প্রবাদেও একে বলা হয় ‘কলুর বলদ’। মশা তারাবার উপকরণ হয়ে আছে সরিষার তেল। আজ যারা প্রবীণ ও মধ্য বয়সী তাদের স্মৃতিতে আছে কীভাবে সন্ধ্যার পর সরিষার তেল কাঁসার থালায় মেখে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা হতো। ছেলে বেলায় ভূত দেখানোর ম্যাজিক দেখানো হতো সরিষার তেল দিয়ে। অন্ধকারে তেলের মধ্যে পাতিলের কালি গুলিয়ে গায়ে মেখে কী মজা করা হতো। নিকট অতীতেও কাজল বানানো হতো সরিষার তেল দিয়ে। ছোট বাটিতে সরিষার তেল ভরে তাতে সলতে চুবিয়ে আগুন দেয়ার পর প্রজ্বলনের সঙ্গে যে কালি উদগিরিত হতো তা ধরে রাখা হতো কাজলদানিতে। এই কাজলে নবজাতকের কপালের কোনে টিপ দেয়া হতো। পুরনো দিনের লোকজন বলত, কাজলের এই টিপে কারও নজর লাগবে না সুদর্শন হবে (অবশ্য যৌবন তারুণ্যে কারও না কারও নজর পড়তো প্রণয়ের আবির্ভাবে)। শীত মৌসুমে শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক রাখতে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর বিষয়টিও রূপক অর্থে এসেছে। চিন্তাবিহীন ঘুমানোর জন্য বলা হয় নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। একটা সময় গ্রামীণ ও শহুরে জীবনে গোসলের আগে সরিষার তেল মুখে হাতে পায়ে বুকে পিঠে উড়ুতে মেখে রোদে জলচৌকিতে কিছুক্ষণ বসে তাপিয়ে নেয়া হতো। তারপর কুয়া বা ইদারার পাড়ে গিয়ে রশিতে ছোট বালতি এঁটে পানি তুলে গোসল হতো। শহুরে জীবনে হস্তচালিত টিউবওয়েলের পানি সরিষার তেল মাখা শরীরে ঢেলে দেয়া হতো। প্রবীণরা বলতেন এভাবে গোসল করলে রোগব্যাধি অনেক কমে যায়। শরীর ঝর ঝরে হয়। আগে সরিষার তেল ছাড়া কোন রান্না হয়নি। সরিষার খাঁটি তেল নেয়ার জন্য হাটবাজার থেকে শিশি বোতলে ভরে তেল আনা হতো। সরিষার তেলে আলু ছানা যে কি স্বাদের এই কথা শুনলে ভোজন রসিকদের জিহ্বায় পানি চলে আসে। আগে সয়াবিনের তেলে রান্নার কথা কেউ ভাবেনি। মনে করা হতো সরিষাই খাঁটি ভোজ্য তেল। শুকনো মুড়ি না খেয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল পেঁয়াজ মরিচ মিশিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়া হয় এখনও। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নত মানের মধু। খুলনার সুন্দরবনে মৌচাকের বাওয়ালিরা সরিষা ফুলের মধুর মৌচাক খুঁজে বেড়ায়। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মৌসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালন করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে বাসা বানায়। এই বাক্সে চাক বানায়। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। ফলে মধু এখন কৃষকের আয়ের বড় পথ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক গ্রামে সরিষা মৌসুমে প্রশিক্ষিত মৌ পালনকারীরা ফসল ঘরে তোলার মতো বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে।
×