ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ একনেকে অনুমোদন হতে পারে

৪৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণস্থল সংরক্ষণে প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৮

৪৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণস্থল সংরক্ষণে প্রকল্প

আনোয়ার রোজেন ॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার বিখ্যাত ‘গেটিসবার্গ ভাষণ’ দিয়েছিলেন ১৮৬৩ সালে। গৃহযুদ্ধ অবসানের পর সেই ভাষণটিই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পায় অনন্য মর্যাদা। পরবর্তীতে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট লিংকনের ভাষণ দেয়ার সেই স্থানটি চিহ্নিত করে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্র। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘৭ মার্চের ভাষণ’। গত বছরের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেড় শ বছর ধরে গেটিসবার্গের ভাষণস্থল সংরক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যে স্থানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর সেই জায়গাটি চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। ওই জায়গাটিসহ উদ্যানের মোট সাতটি ঐতিহাসিক স্থান চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য একটি প্রকল্পও চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা এবং সংলগ্ন শিশু পার্কে শিশু পার্কে শিশুদের চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পালনের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে। আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে। এ পর্যায় বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। একনেকে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদফতর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বাস্তবায়ন করবে। উল্লেখ্য, ৭ মার্চের ভাষণের জায়গাটিসহ উদ্যানের মোট সাতটি ঐতিহাসিক স্থান চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করতে সরকারকে প্রায় আট বছর আগে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে ২০০৯ সালের ২৫ জুন উচ্চ আদালতে রিট করেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। ওই বছরের ৮ জুলাই বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদের আদালত এ বিষয়ে রায় দেন এবং ২০১০ সালের জুলাই মাসে লিখিত রায় প্রকাশ করা হয়। সাত ঐতিহাসিক স্থান ॥ রায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে সাতটি স্থান সংরক্ষণের আদেশ দেয়া হয় সেগুলো হচ্ছে- ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণের স্থান, একই বছরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থান, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের স্থান, পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান, একই বছর ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থান, ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর ২৩ ফেব্রুয়ারি যে স্থানটিতে কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল এবং ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গবর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের স্থান। সংবিধানের ২৩ ও ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য দেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এসব অবিস্মরণীয় ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখা এবং স্থানগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা এ জাতির আইনগত ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। আদালত বলেন, যদি কেউ বাঙ্গালী হয়ে থাকেন, তাহলে ওইসব স্থানে দাঁড়িয়ে তার প্রাণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে। আদালতের রায়ে এসব স্থান চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণার্থে স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাজনীতিক, ইতিহাসবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওই কমিটির অন্যতম সদস্য ও স্থান সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদনকারীদের একজন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন পদত্যাগ করেন। এ বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, এটা নিশ্চয়ই খুশির খবর। তবে প্রকল্পটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আদালতের রায় অনুযায়ী গুরুত্ব বিবেচনায় উদ্যান সংলগ্ন অনেক অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও ভাসমান স্থাপনা থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তবে উদ্যানের সার্বিক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন নয়। সরকারের নেয়া প্রকল্পে আদালতের রায় প্রতিফলিত হয় কি-না সেটাই এখন দেখার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এ উদ্যানে সংঘটিত সকল ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণীয় করে রাখাসহ নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিকামী জনগণের অত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরার জন্য ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প ১৯৯৮ সালের ২৯ অক্টোবর একনেকে অনুমোদিত হয়। কিন্তু প্রকল্পটি অসমাপ্ত অবস্থায় ২০০৫ সালের জুনে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে অসম্পূর্ণ থাকা ১৫০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্বাধীনতা স্তম্ভসহ অন্যান্য কিছু কাজ ২০১২ সালের জুনে সমাপ্ত করা হয়। কিন্তু উদ্যানটির কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন- ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ইত্যাদি স্থানগুলো এখনও সংরক্ষণ করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ^প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেয়ার স্থান সংরক্ষণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ফলে এ সকল ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণসহ কিছু আনুষঙ্গিক কাজ ও শিশুপার্কের উন্নয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য ২৩৮ কোটি ১৬২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে এবং ২০১৬ সালের জুলাই হতে ২০১৯ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনা করে বারবার পর্যায় ভিত্তিক প্রকল্পগ্রহণ না করে মূল স্থাপত্য নকশা সমন্বয় করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্কেও একটি মহাপরিকল্পনা করে একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই অবশিষ্ট সকল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য স্থাপত্য অধিদফতর শিশু পার্কসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে এবং এর স্থাপত্য নকশায় উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানগুলো, দর্শনার্থীদের জন্য সুবিধাদি, শিশু পার্কের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় স্থাপনা ও রাইড ইত্যাদি সকল অঙ্গ চিহ্নিত করে প্রদর্শন করতে হবে। স্থাপত্য অধিদফতর প্রণীত মহাপরিকল্পনার স্থাপত্য নকশাটি চূড়ান্তকরণে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। পিইসি সভার এসব সিদ্ধান্তের কারণে স্থাপত্য অধিদফতর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে মহাপরিকল্পনার স্থাপত্য নকশাটি চূড়ান্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন গ্রহণ করে। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদফতর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন পিইসি সভার অন্যান্য সিদ্ধান্তের জন্য ডিপিপি পুনর্গঠন করে। পুনর্গঠিত ডিপিপির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ঐতিহাসিক এসব স্থানে গাম্ভীর্যপূর্ণ স্থাপনা ও স্তম্ভ নির্মাণের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছিল। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালতের রায়ের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদ ও দায়িত্ববোধ সরকারের রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানগুলো চিহ্নিত করা হলেও এতদিন নানা জটিলতার কারণে প্রস্তাবিত স্মারক বা চিহ্ন বসানো যায়নি। এখন আর কোন জটিলতা নেই। প্রকল্পটির মাধ্যমে স্থান সংরক্ষণের পাশাপাশি পাকিস্তান পর্বের ২৪ বছরের ইতিহাসই তুলে ধরা হবে। জানা গেছে প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলো হচ্ছে- ৭ মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের স্থানগুলোতে ভাস্কর্য নির্মাণ, স্বাধীনতা টাওয়ার প্লাজার রেনোভেশন, জনসভার মঞ্চ, ক্যাফেটেরিয়া, বসার বেঞ্চ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, বৈদ্যুতিক কাজ, শিশু পার্কের দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন, বিভিন্ন ধরনের ১৩টি রাইড স্থাপন এবং জলাধার নির্মাণ করা হবে।
×