ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা থেকে পাস করে দেশে ফিরে এ দেশের ওষুধের নাম লিখছেন ডাক্তাররা

বাংলাদেশের ওষুধের বড় বাজার হতে যাচ্ছে নেপাল

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশের ওষুধের বড় বাজার হতে যাচ্ছে নেপাল

এম শাহজাহান ॥ ডাঃ রামপ্রসাদ সেন কাঠমান্ডুর মডেল হাসপাতালের ভাল চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন কয়েক বছর আগেই। ঢাকার বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করে ২০১২ সালে ফিরে যান নিজ মাতৃভূমি নেপালে। নিজ দেশে ফিরলেও বাংলাদেশকে ভুলে যাননি এ চিকিৎসক। ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের খোঁজখবর রাখেন তিনি। রোগীদের চিকিৎসাপত্রে অবিরাম লিখে যান বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের নাম। এ যেন পূর্বঋণ শোধ করা! শুধু ডাঃ রামপ্রসাদ সেনই নন, তাঁর মতো অসংখ্য নেপালী ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে জায়গা করে নিয়েছে এদেশে তৈরি প্যারাসিটামল, নাপা, ওরস্যালাইন, ডায়াবেটিস- প্রেসারের ওষুধ, গ্যাস্ট্রিকের এন্টাসিড প্লাসসহ নাম না জানা অসংখ্য ওষুধ। রোগীরা এসব ওষুধ কেনে নেন স্থানীয় ফার্মেসি থেকে। এতে করে বাংলাদেশী ওষুধের একটি বড় সম্ভাবনাময় বাজার হতে যাচ্ছে হিমালয় কন্যাখ্যাত নেপাল। জানা গেছে, তিন কোটি জনসংখ্যার দেশ নেপালে ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। আমদানি নির্ভর ও সার্কভুক্ত এদেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বর্তমানে দেশটিতে বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হচ্ছে। রফতানিকৃত পণ্যের মধ্যে ওষুধ অন্যতম উপাদান। প্রতিবছর বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ৬ শতাধিক নেপালী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে থাকেন। শিক্ষাজীবন শেষে আবার এরা নিজ দেশে ফিরে যান। পরবর্তীতে কর্মসংস্থান ও সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে নেপালের সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, বিভিন্ন চেম্বার ও নার্সিং হোমে যোগদান করেন এসব চিকিৎসক। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লেখেন বাংলাদেশী সব ওষুধের নাম। এ কারণে নেপালের সব ফার্মেসিতে সহজেই মিলবে বাংলাদেশী সব ওষুধ। বাংলাদেশে তৈরি ইলেক্ট্রনিক্স, মোবাইল ফোন এবং অটোমোবাইলস পণ্যের মতো পাল্লা দিয়ে সেখানে বাড়ছে ওষুধের চাহিদাও। ওখানকার ডাক্তাররা বলছেন, বাংলাদেশের প্রতি আমাদের অফুরান ভালবাসা রয়েছে। শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় বাংলাদেশে কাটানো হয়েছে। আমাদের অনেক ঋণ আছে। এছাড়া ওষুধের মান বিশ্বমানের। নেপালের পাশাপাশি আর ৯০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। আর এ কারণেই ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশী ওষুধ লেখা হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডাঃ রামপ্রসাদ সেন জনকণ্ঠকে বলেন, সত্যিই নেপালের বেশির ভাগ ডাক্তার বাংলাদেশের কাছে ঋণী। বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের দেশটির প্রতি অনেক ভালবাসা রয়েছে। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকার পরও বাংলাদেশ এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, রফতানি বাণিজ্য এবং খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমরা সব সময় বাংলাদেশের পাশে ছিলাম। এখন নেপালে কাজ করলেও আমরা দেশটিকে ভুলে যাননি। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশী তৈরি ওষুধের নাম লিখছি। নেপাল এখন বাংলাদেশী পণ্যের একটি বড় বাজার হতে যাচ্ছে। কাঠমান্ডুর পর্যটন এলাকা হিসেবে খ্যাত থামেলের একটি চেম্বারে কাজ করেন ডাঃ প্রদীপ কুমার। তিনি ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাস করে নিজ দেশ নেপালে ফিরে যান। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে তিনিও লেখেন বাংলাদেশী সব ওষুধের নাম। তিনি জানালেন, কাঠমান্ডুর পাশাপাশি নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ডাক্তাররা বাংলাদেশী ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশী ওষুধের নাম লিখছেন। তিনি বলেন, ওই দেশে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে। এ কারণে প্রতিবছর একবার হলেও বাংলাদেশে যাওয়া হয়। এদিকে গত ২০১৫ সালে নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও নানা সমস্যা তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য নেপালে সাতজন করে চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী আছেন এবং হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা মাত্র ৫০। যদিও প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য অন্তত ৩৪ দশমিক ৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী দরকার। সেই হিসেবে চিকিৎসা সেবায় বড় ধরনের ঘাটতি আছে নেপালে। স্বাস্থ্য খাতের এসব সমস্যা সমাধান ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দেশটির চিকিৎসকেরা গত চার বছরে ১০ বার অনশন করেছেন। গত বছরের ডিসেম্বরেও সর্বশেষ অনশন হয়েছে। এখনও সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বিধ্বংসী ভূমিকম্পে সেই সময় দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্লিনিক ও হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। এরা স্বাস্থ্যসেবার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত ক্লিনিকের ওপরই নির্ভরশীল। আর যারা শহরে থাকে, তাদের ভরসা হাসপাতালগুলো, যার অধিকাংশই আবার বেসরকারী। সূত্রমতে, দেশের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে বিদেশী শিক্ষার্থী দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই মোট আসনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারেন। গত ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ১৫শ’ বিদেশী শিক্ষার্থী দেশের সরকারী-বেসরকারী মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারী মেডিক্যাল কলেজে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন ৬০ শিক্ষার্থী। এই ৬০ জন সার্কভুক্ত দেশের শিক্ষার্থী। এছাড়া বিদেশী শিক্ষার্থীর মধ্যে ভারত ও নেপালের শিক্ষার্থীই সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে সামস জনকণ্ঠকে বলেন, মেডিক্যাল পড়তে নেপালী শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। প্রতিবছর ৬ শতাধিক শিক্ষার্থী মেডিক্যাল পাস করে নেপালে ফিরে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নিজ দেশে ফিরে এসে এসব ডাক্তার রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে বাংলাদেশী ওষুধ লিখছেন। এতে করে নেপালে দ্রুত বাংলাদেশী ওষুধের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। তিনি বলেন, নেপালের অনেক ডাক্তার বলছেন, বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের গুণগুতমানও অনেক ভাল। বাংলাদেশী পণ্যের একক বাণিজ্যমেলা হবে নেপালে ॥ আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে কাঠমান্ডুতে পাঁচদিনব্যাপী বাংলাদেশী পণ্যের একক বাণিজ্যমেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। চতুর্থবারের মতো এই মেলা হতে যাচ্ছে। এ বছর বেশিসংখ্যক বাংলাদেশী কোম্পানি নেপালের এই মেলায় অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে সামস। তিনি বলেন, বাংলাদেশী ব্র্যান্ড, রহিম আফরোজ, ওয়ালটন, রানার ও প্রাণ ইতোমধ্যে নেপালে পণ্য বাজারজাতকরণ শুরু করেছে। এসব কোম্পানির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশটিতে। এছাড়া নেপালে হোম এ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে বিছানার চাদর, সিরামিকস এবং কনস্ট্রাকশন পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানান ওই সময়ে নেপালে ৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানি হয়েছে। প্রতিবছর রফতানির পরিমাণ বাড়ছে। আশা করছি এ বছর রফতানি ৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা ও কাঁকর ভিটার অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। এছাড়া শুল্কজনিত যেসব সমস্যা রয়েছে তাও দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশী তৈরি প্লাস্টিকপণ্যের চাহিদা রয়েছে নেপালে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর অফিসিয়ালি ২৫-৩০ হাজার বাংলাদেশী পর্যটক হিসেবে নেপাল সফর করছেন। এ কারণে বাংলাদেশী সব ধরনের খাদ্যপণ্যের চাহিদা আছে দেশটিতে। পর্যটকদের ভ্রমণ আরামদায়ক ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রতিদিন নেপালের উদ্দেশে তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
×